হিস্টিরিয়া : রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ ও কারণ

দৈহিক ব্যাধির সাথে যে মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক কারণের সম্পর্ক রয়েছে, সাম্প্রতিককালে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। মনস্তাত্ত্বিক কারণ বলতে চাপ (Strain) এবং আবেগগত দ্বন্দ্ব বা সংঘাত-এর কথা বলা হচ্ছে। রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়া উপর্যুক্ত ব্যাধির একটি শ্রেণিবিশেষ।

রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়া (হিস্টিরিয়া)

রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়া বা হিস্টিরিয়া ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তাজনিত মানসিক রোগ। ব্যক্তির মানসিক দুশ্চিন্তার চাপ যখন শারীরিক উপসর্গে পরিণত হয় তখন একে রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়া বা হিস্টিরিয়া বলা হয়। এ মনোব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি এমন একটি মানসিক অসুবিধা বা সংকটের সম্মুখীন হয় যাকে সে গ্রহণ করতে পারে না। তখন ব্যক্তি নিজের শরীরে একটি শারীরিক ব্যাধির সৃষ্টি করে এবং এর দ্বারা ঐ অসুবিধা বা সংকটকে এড়িয়ে যেতে চায়। রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়া বা হিস্টিরিয়া বলতে মানসিক দ্বন্দ্বকে একটি দৈহিক লক্ষণে রূপান্তর করা বোঝায়। মনোব্যাধির বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগের মধ্যে এটি সবচেয়ে প্রচলিত ব্যাধি। হিস্টিরিয়াকে এক ধরনের গুরুতর মানসিক বা প্রক্ষোভমূলক অপসংগতির ক্ষেত্র বলে বর্ণনা করা হয়। এ রোগের বৈশিষ্ট্য হলো-এটি শুধু আবেগগত সংঘাতের পরিণতি নয়। এটি সংঘাত বা দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্য একটি অপ্রীতিকর উপায় সন্ধান করে। আমাদের দেশে সচেতনতার অভাবে অশিক্ষিত মানুষ এমনকি শিক্ষিত মানুষও হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জিন-ভূতের আছর বলে মনে করে এবং কবিরাজ, ফকির, ওঝা দ্বারা তাদের নির্যাতনমূলক চিকিৎসা শুরু করে। কিন্তু এটি মোটেই উচিত নয়।

মনোবিজ্ঞানী কিসকার (Kisker) বলেন, ব্যক্তির মানসিক দুশ্চিন্তার চাপ যখন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে তখন এ অবস্থাকে বলা হয় হিস্টিরিয়া। আবার যখন স্নায়বিক উপসর্গগুলো অস্বাভাবিক আচরণকে প্রলুব্ধ করে তখন এই অবস্থাকে বলা হয় মানসিক রোগ বা মানসিক নিষ্ক্রিয়তা।

রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়া/হিস্টিরিয়ার লক্ষণসমূহ

রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়াতে মানসিক কোনো আঘাত, সংঘাত বা মানসিক কোনো কারণকে কেন্দ্র করে দৈহিক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ রোগে যে শারীরিক উপসর্গ প্রকাশ পায় তা শারীরিক বিভিন্ন রোগের অবিকল অনুরূপ। কোন প্রকারের শারীরিক রোগের অনুরূপ রোগ লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তা নানা কারণের উপর নির্ভর করে। এ রোগের লক্ষণকে সাধারণত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:

১. সংবেদন (Sensory)-এর গোলযোগ: 

হিস্টিরিয়া রোগীদের সংবেদনের গোলযোগের প্রকাশ বহু রকমের হতে পারে, যেমন, অন্ধ হয়ে যাওয়া, রাতকানা, বর্ণান্ধ, অনুভূতি লোপ পাওয়া, অস্পষ্ট দৃষ্টি (Blurred vision), এক বস্তুর জায়গায় দুটি দেখা (Double vision)।

২. অঙ্গসঞ্চালনের (Motor) বিকৃতি: 

হিস্টিরিয়া রোগীদের বিভিন্ন ধরনের অঙ্গসঞ্চালনের বিকৃতি দেখা যায়। এসবের মধ্যে অবশাঙ্গতা বা প্যারালাইসিস প্রধান। রোগীর যে কোনো অঙ্গের অর্থাৎ হাত বা পায়ের আংশিক বা পুরোপুরি অবশাঙ্গতা হতে পারে। শরীরের অর্ধেক অচল হয়ে যেতে পারে (Hemiplegia)। এসব অবশাঙ্গতার স্নায়বিক কোনো কারণ নেই। অবশাঙ্গতা ছাড়াও এসব রোগীদের মধ্যে অন্যান্য বহু ধরনের বিকৃতি দেখা যায়। যার একটি হলো 'Astasis - Abasia'। এ ধরনের রোগী পায়ের জোরে দাঁড়াতে অক্ষম, কিন্তু শুয়ে শুয়ে সে অনায়াসে ও সজোরে পা নাড়তে পারে। এসব রোগীর মধ্যে কথার গন্ডগোল দেখা যায়। অনেক সময় রোগীর বাকশক্তি রোধ হয়ে যায় (Mutisin), অনেক সময় তোতলামি দেখা যায়।

৩. আভ্যন্তরীণ (Visceral) গোলযোগ: 

হিস্টিরিয়া রোগীদের যেসব আভ্যন্তরীণ গোলযোগ দেখা দেয় সেগুলো হলো- মাথা ধরা, মাথা ঘোরা, গলায় টিউমার, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড়ানি, বমি হওয়া ইত্যাদি। এছাড়া হিস্টিরিয়া রোগীদের একটি বিশেষ অবস্থা দেখা যায়, তাকে বলা হয় Anorexia Nervosa। এতে থাকে খাদ্যে সম্পূর্ণ অনীহা, রোগী কোনো কিছুই খেতে চায় না, জোর করে কিছু খাওয়ালে তক্ষুনি তা বমি হয়ে বেরিয়ে যায়।

রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়ার/হিস্টিরিয়ার কারণসমূহ: 

হিস্টিরিয়া দুটি কারণে সৃষ্টি হতে পারে; যথা: ১. পরোক্ষ বা পূর্বগামী কারণ, ২. প্রত্যক্ষ সংঘটক কারণ। নিম্নে এ কারণ দুটি বর্ণনা করা হলো:

১. পরোক্ষ বা পূর্বগামী কারণ: 

হিস্টিরিয়া রোগী অপরের দৃষ্টি বা মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মাথা বা হাতে পক্ষাঘাত বা অন্য কোনো শারীরিক লক্ষণের সৃষ্টি করে। এর প্রতিক্রিয়াগুলো অচেতনধর্মী। হিস্টিরিয়া রোগী সত্য সত্যই অসুস্থতা সৃষ্টি করে এবং এ অসুস্থতার সাহায্যেই সে তার ঈন্সিত লক্ষ্যে পৌঁছায়। শারীরিক অসহায়তা ও অক্ষমত্য অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে নিছক জৈবিক ঘটনা মাত্র। কিন্তু হিস্টিরিয়া রোগীর ক্ষেত্রে শারীরিক অসহায়তা ও অক্ষমতাই বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এক কথায়, যে ছাত্র পেটব্যথার ভান করে স্কুল ফাঁকি দেয় তার সাথে হিস্টিরিয়া রোগীর আচরণ ও উদ্দেশ্যের কোনো পার্থক্য নেই। মনোবিকারের দিক থেকে হিস্টিরিয়া হলো প্রাপ্য ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অনুভূতি থেকে সৃষ্ট এক ধরনের মনোবিকারমূলক প্রতিক্রিয়া মাত্র।

২. প্রত্যক্ষ সংঘটক কারণ: 

পরিবেশের আঘাতত্মিক অভিজ্ঞতাকে প্রত্যক্ষ সংঘটক কারণ বলা যায়। প্রত্যক্ষ সংঘটক কারণ বিভিন্ন রকমের হতে পারে; যেমন-

প্রথমত, যেসব ঘটনা ও পরিস্থিতি ব্যক্তির অহংসত্তার অবদমিত এবং সুপ্ত প্রবণতাকে সতেজ ও সক্রিয় করে তোলে সেগুলোর মধ্যে হিস্টিরিয়া সৃষ্টি করতে পারে। হিস্টিরিয়ার এ অবদমিত প্রবণতাটি হলো প্রত্যাখ্যাত ভালোবাসা কিংবা আত্মঅনুকম্প। 

দ্বিতীয়ত, যেসব ঘটনা বা পরিস্থিতি ব্যক্তির অধিসত্তাকে দুর্বল করে দেয় বা তার সংঘটকটিকে নষ্ট করে, সেগুলো হিস্টিরিয়ার প্রত্যক্ষ কারণরূপে কাজ করতে পারে। মনোব্যাধিগ্রস্ত রোগীর ক্ষেত্রে অধিসত্তা হলো অস্বাভাবিক, অতিস্ফীতি এবং অসুস্থতা। ব্যক্তির স্বাভাবিক প্রবণতাগুলোকে দমন করাই তার কাজ।

৩. পলায়ন মনোবৃত্তি: রোগীর কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে এমন এক পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বেড়াবার ইচ্ছাই হলো পলায়ন মনোবৃত্তি। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি কাজের চাপ বেশি দেখে অবসর গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তার অবসর গ্রহণের বয়স হয়নি। যদি নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সে অবসরগ্রহণ করে, তবে তাকে আর্থিক দুরবস্থায় পড়তে হতে পারে এবং এক হিসেবে এই অবসর গ্রহণ তার পক্ষে নিজের ব্যর্থতাকে স্বীকার করে নেওয়া। এই পরিস্থিতিতে সে তার মধ্যে এমন এক ব্যাধির সৃষ্টি করে, যা তার অবসর গ্রহণের ব্যাপারে সহায়ক হবে অথচ তার কোনো রকম অখ্যাতি হবে না। এসব ক্ষেত্রে যে রোগ তার ক্ষেত্রে দেখা যায় তা তার কাজের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যার থেকে সে পালিয়ে বেড়াবার সুযোগ পায়; যেমন, কোনো শল্যচিকিৎসকের অস্ত্রোপচার করতে দিয়ে হয়ত হাত কাঁপে। এ কথা বলা দরকার যে, রোগী তার ব্যাধি সম্পর্কে সচেতন-তা নয়।

৪. সমবেদনা ও মনোযোগ লাভ: এ রোগের একটি কারণ হলো অপরের সমবেদনা ও মনোযোগ লাভ করার ইচ্ছা। এটা শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। যখন শিশু দেখে পরিবারে নতুন একটি শিশুর আবির্ভাব ঘটেছে এবং পরিবারের সদস্যদের মনোযোগ নবজাত শিশুর দিকে ধাবিত হয়েছে, তখন সে মনে করে যে, সে অবহেলিত হচ্ছে, যদিও তার এ ধারণা অযৌক্তিক।

৫. ইডিপাস কমপ্লেক্স (Oedipus complex): মনঃসমীক্ষক ফ্রয়েড হিস্টিরিয়া রোগের কারণের ব্যাখ্যা যৌনতাকে কেন্দ্র করেই দিয়েছেন। মনঃসমীক্ষার গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের ইডিপাস কমপ্লেক্স কখনই সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে যায় না। সন্তানের পিতা বা মাতার মধ্যে যে তার বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তি, তার প্রতি ভার আসক্তি ও আকর্ষণ থেকেই যায়। পরবর্তী জীবনে যখনই বাইরের পৃথিবীতে তাদের প্রেম ও কাম জীবনের বাধা দেখা দেয়, তখনই এরা মনের গভীরের প্রেরণায় শৈশবের সেই পিতৃ বা মাতৃআসক্তি ও আকর্ষণের কল্পনায় ব্যাপৃত হয়। এর ফলে এদের মনের গভীরে দেখা দেয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, দোষবোধ (guilty feeling) এবং আগ্রাসী মনোবৃত্তি। তারই বহিঃপ্রকাশ হয় এদের বিভিন্ন রোগ লক্ষণাবলিতে।

রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়া/হিস্টিরিয়ার চিকিৎসা 

হিস্টিরিয়া রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রথমে রোগীকে তার প্রকৃত অসুবিধা জানতে এবং ব্যাধিটির প্রকৃত স্বরূপ যথাযথ নির্ধারণে সাহায্য করতে হবে। রোগের মূল সমস্যাটি যাতে রোগী নিজে নিজে সমাধান করতে পারে সেজন্য তাকে পরামর্শ ও নির্দেশ দিতে হবে। হিস্টিরিয়ার আর একটি চিকিৎসা-পদ্ধতি হচ্ছে রোগীর কাছে তার রোগের লক্ষণগুলোকে অতৃপ্তিকর করে তোলা; যেমন- চিকিৎসক রোগীকে খুব তিক্ত আস্বাদযুক্ত কোনো ওষুধ বা বেদনাদায়ক কোনো ইনজেকশন দিয়ে জানালেন যে, যত দিন না তার লক্ষণগুলো চলে যাচ্ছে তত দিন এ চিকিৎসা চলতে থাকবে। এতে দেখা যাবে, রোগীর লক্ষণগুলোহঠাৎ একদিন অন্তর্হিত হয়েছে।

হিস্টিরিয়ার প্রধান চিকিৎসা হলো রোগীর ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ্বটি উন্মোচন করা এবং তা সমাধানের ব্যবস্থা করা। শুধু লক্ষণসমূহ দূর করেই এ রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। এর পূর্ণ নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়, সতকর্তা ও যত্ন। আর এ জন্য প্রয়োজন রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে গভীর পারস্পরিক বিশ্বাস ও প্রীতির সম্বন্ধ স্থাপন করা, যাতে রোগী নির্দ্বিধায় তার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণগুলো চিকিৎসকের কাছে প্রকাশ করতে পারে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়া বা হিস্টিরিয়া একটি জটিল মনোব্যাধি। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কত অসহায় নারী-পুরুষ ওঝা, কবিরাজের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই এ রোগের প্রকৃত কারণ উন্মোচন এবং সঠিক চিকিৎসা-পদ্ধতি প্রচার করে জনগণকে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। যেহেতু আবেগবশত এ রোগ ঘটছে, দৈহিক কারণবশত নয়, সেহেতু এ রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যক্তির মনোবলই যথেষ্ট।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url