একটি গবেষণা প্রতিবেদন লিখনের ধাপসমূহ

মনোবিজ্ঞানে গবেষক যখন তাঁর পরিকল্পনা ও নকশা অনুসারে পরীক্ষণ (গবেষণা) পরিচালনা শেষ করেন, তখন উক্ত গবেষণার ফলাফল জনসন্মুখে প্রকাশ করা তাঁর কর্তব্য। তাই পরীক্ষণ পরিচালনার পর তিনি প্রতিবেদন লেখার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রতিবেদন লেখার সময় তাকে অবশ্যই দৃষ্টি রাখতে হবে যে, তাঁর এ প্রতিবেদনটি সমাজের কোন শ্রেণির পাঠকরা পড়বে। সেসব পাঠকদের কথা বিবেচনায় এনে প্রতিবেদনের ভাষা ঠিক করতে হবে। 

পরীক্ষণের প্রতিবেদন লেখার ধাপ: 

১. শিরোনাম (Title page): Title page এ তিনটি Elements বা উপাদান থাকতে হবে। যথা-

ক. গবেষণার শিরোনাম বা Title: কোনো পরীক্ষণের একটি শিরোনাম থাকা আবশ্যক। শিরোনামটি সংক্ষিপ্ত, চিত্তাকর্ষক এবং পরীক্ষণ সম্পর্কে সহজে ধারণা করা যাবে। Title ১২-১৫ শব্দের মধ্যে হওয়া উচিত। Title খাতার ১ম পৃষ্ঠায় লিখতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, খাতার এ পৃষ্ঠায় কোনো পৃষ্ঠা সংখ্যা দেওয়ার দরকার পড়ে না।

খ. গবেষকের নাম বা Authors name : Authors name খাতার মাঝখানে Title এর নিচে লিখতে হবে। এ পৃষ্ঠায় অর্থাৎ শিরোনাম পৃষ্ঠায়ই গবেষকের নাম এবং সে বা তারা কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত তার নাম ঠিকানা লিখতে হবে।

গ. সংক্ষিপ্ত শিরোনা ও পৃষ্ঠা বা Running head & Page Number: Title Page এর উপরের ডানদিকের কোণায় Running head বা গবেষণার চলমান শিরোনাম লিখতে হবে। এটি হবে সংক্ষিপ্ত আকারে ৫০ শব্দের মধ্যে। পৃষ্ঠা নং থাকবে বাম দিকে। 

এছাড়াও আরো যা থাকবে-

২. সারাংশ: এটা শিরোনাম পৃষ্ঠার পরবর্তী পৃষ্ঠায় হবে। খুব সংক্ষেপে সমগ্র পরীক্ষণের বিভিন্ন অংশের বর্ণনা বিশেষ করে ফলাফল ও আলোচনার ভিত্তিতে সংক্ষিপ্ত অংশটির বর্ণনা করতে হবে। গবেষক প্রতিবেদনের প্রথম পৃষ্ঠায় সারসংক্ষেপ লেখবেন, কারণ পাঠক প্রথমে সারাংশ পড়ে গবেষণার বিষয়ে সামগ্রিক ধারণা লাভ করতে পারবে।

Title Page এর পর যদি প্রতিবেদনটি কোনো সাময়িকীতে উপস্থাপনের জন্য লেখা হয়, তবে Abstract Page নতুন পৃষ্ঠায় বা সবার শেষে সারাংশ হিসেবে লিখতে হয়। প্রতিবেদনের শেষ পর্যন্ত তা ক্রমানুসারে দিয়ে যেতে হয়। এ পৃষ্ঠার নম্বর হবে ২, কারণ প্রথম পাতা ছিল Title Page। সারাংশের দৈর্ঘ্য 150-250 শব্দের মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং তা এমন হওয়া উচিত যেন তা পড়ে সম্পূর্ণ পরীক্ষণটি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে সারাংশের মধ্যে কোনো নির্দেশনা দেয়া যাবে না। পরীক্ষণে ব্যবহৃত বিশেষ শব্দগুলোকে Keyword বলা হয়। এগুলো Abstract Page এ লিখতে হয়।

৩. প্রধান অংশ: প্রধান অংশ তিনটি ভাগে বিভক্ত করে লিখতে হবে। যথা-

৩.১: ভূমিকা: গবেষণা যে বিষয়ের ওপর করা হচ্ছে তা বিস্তারিতভাবে লিখতে হবে। এখানে গবেষণার সমস্যাদি উপস্থিত করা। হবে এবং এ বিষয়ে বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইতঃপূর্বে যেসব গবেষণা হয়েছে, সেসব গবেষণার সার সংকলন করতে হবে। পূর্ববর্তী গবেষণার ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা প্রভৃতি নির্দেশ করতে হবে এবং ক্রমশ বর্তমান গবেষণার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে। পটভূমিকার শেষ পর্যায়ে বর্তমান গবেষণার সমস্যাটি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে হবে। যেমন-একটি পরীক্ষণ "নিরপেক্ষ ও আবেগীয় শব্দে প্রত্যক্ষণের প্রতিক্রিয়াকাল নির্ণয় কর।" এক্ষেত্রে, নিরপেক্ষীয়, আবেগীয়, প্রতিক্রিয়াকাল প্রভৃতি শব্দগুলো সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।

ক. ঐতিহাসিক পটভূমি: এটা উপশিরোনাম হবে। যে বিষয়ের ওপর গবেষণা করা হচ্ছে, সে বিষয়ে পূর্বে যারা গবেষণা করেছেন, কী ফলাফল পেয়েছেন এগুলো লিখতে হবে। 

খ. প্রকল্প: পরীক্ষক বর্তমান পরীক্ষণের সমস্যা, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পরীক্ষণের ফলাফল পর্যালোচনা করে যদি প্রকল্প প্রণয়ন করেন তা এ ধাপে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করবেন। প্রকল্প সর্বদা Future Tense এ লিখতে হয়।

গ. চল: বর্তমান পরীক্ষণের অনির্ভরশীল ও নির্ভরশীল চল কোনটি তা এখানে উল্লেখ করতে হয়।

ঘ. সমস্যা: বর্তমান পরীক্ষণের সমস্যাটি কি তা এখানে লিখতে হবে। এটাও Sub-heading হবে।

ড. উদ্দেশ্য

চ. সাহিত্য পর্যালোচনা

ছ. যৌক্তিকতা

৩.২: পদ্ধতির ও কার্যক্রম:

ক. নমুনা সংখ্যা: বর্তমান গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনার সংখ্যা উল্লেখ করতে হবে। কোন কোন নমুনাকে কোন কোন দলে বিভক্ত করা হয়েছে তাও উল্লেখ করতে হবে। অনেক বড় গবেষণায় Sample লেখা হয়। Sample এর ক্ষেত্রে কতজন নেওয়া হয়েছিল তা উল্লেখ করতে হবে। এছাড়াও পরীক্ষণপাত্রের নাম, লিঙ্গ, বয়স, আর্থসামাজিক অবস্থা উল্লেখ করতে হবে।

খ. পরীক্ষণ কার্যক্রম: এটি উপশিরোনাম হিসেবে লিখতে হবে। Subject কে গবেষণাগারে আনা এবং পরীক্ষণ শেষ পর্যায় পর্যন্ত যেসব কাজ করানো হয় এবং যে উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তা এ ধাপের অন্তর্ভুক্ত। এ অংশটুকু Past tense এ লিখতে হয়।

গ. যন্ত্রপাতি: যেসব যন্ত্রপাতি পরীক্ষণে ব্যবহার করা হয়েছে তা বিশদভাবে লিখতে হবে। যদি পরীক্ষক নতুন কোনো যন্ত্র ব্যবহার করেন, তবে যন্ত্রটির ছবি প্রতিবেদনে প্রদর্শন করতে হবে। আর যদি যন্ত্রটি বহুল প্রচলিত হয়, তবে নাম উল্লেখ করলেই চলবে। যেমন-স্মৃতি যন্ত্র।

ঘ. গবেষণা নকশা: এ অংশে গবেষক গবেষণা নকশার বর্ণনা এবং নকশাটি উপস্থাপন করবেন। তিনি কোন পদ্ধতিতে পরীক্ষণপাত্র নির্বাচন করলেন, কী পদ্ধতিতে দলে ভাগ করলেন, চলকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেন, এসবের বর্ণনা দিতে হবে এবং সবকিছুই Future Tense এ লিখতে হবে।

৩.৩ : ফলাফল: ফলাফল শিরোনাম হিসেবে লিখতে হয়। ফলাফল লেখার সময় বিশেষ মনোযোগ দিয়ে লিখতে হয়, যাতে Common error গুলো না হয়। ফলাফল উপস্থাপনের ওপর প্রতিবেদনের আকর্ষণ অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। সাধারণত ফলাফলকে দু'ভাবে পেশ করা যায়। যথা-১. ছকের সাহায্যে, ২. গ্রাফের সাহায্যে।

৩.৪: আলোচনা: এটা শিরোনাম হিসেবে লিখতে হবে। ফলাফলের বিস্তৃত বর্ণনা, বিশ্লেষণকে আলোচনা বোঝায়। আলোচনায় কোন সমস্যা নিয়ে কাজ করেছি, যন্ত্রপাতি কী ছিল Subject কতজন ছিল, Hypothesis কী ছিল, Result কি Hypothesis কে সমর্থন করেছে বা না করলে কেন করেনি তার সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। পূর্বে ঐ বিষয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তাদের নাম লিখতে হবে এবং তাদের ফলাফলের সাথে বর্তমান ফলাফলটি মিলে কি না, না মিললে কেন মিলেনি, যাদের সাথে মিলেনি তাদের নাম উল্লেখ করতে হবে।

৪. গ্রন্থপঞ্জি: এটি সম্পূর্ণ একটি নতুন পৃষ্ঠায় আরম্ভ করতে হবে। প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে যেসব গ্রন্থের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে সেসব গ্রন্থের নাম লিখতে হবে। গ্রন্থপঞ্জি লেখার সময় বর্ণমালা অনুসারে সাজিয়ে লিখতে হবে। প্রথমে A দিয়ে কোনো লেখকের নাম থাকলে 4 দিয়ে আর না থাকলে B দিয়ে লিখতে হবে। আর দুজনের নাম একই বর্ণমালা দিয়ে হলে 2nd অংশের দিকে লক্ষ্য রেখে বর্ণমালা অনুসারে লিখতে হবে। প্রথমে লেখকের নাম, তারপর গ্রন্থের নাম, গ্রন্থের প্রকাশকাল লিখতে হয়। লেখকের নামের ক্ষেত্রে আগে শেষের অংশ লিখতে হয়, তারপর বাদবাকি সবকিছু। যেমন- Rowshan Ali লিখতে হবে- Ali, R. (1995), Heading Writing General এরপর underline করে দিতে হবে।

৫. পরিশিষ্ট: এটা সম্পূর্ণ আলাদা পৃষ্ঠায় Heading আকারে হবে। এ পর্যায়ে ডাটা শীট, গ্রাফ, পরীক্ষকের প্রতি নির্দেশনা, পরীক্ষকের মন্তব্য প্রভৃতি অতিরিক্ত কাগজে আটকে দিতে হবে।

Research report লেখার ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। অন্যথায়, সে Report লেখা পূর্ণাঙ্গ হবে না।

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, একজন গবেষককে একটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত আকারে উপস্থাপন করার জন্য উপযুক্ত ধাপসমূহ অতিক্রম করতে হবে। এসব ধাপ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার পরই একটি প্রতিবেদন প্রকাশের উপযোগী হয়। উক্ত ধাপসমূহ যদি সঠিকভাবে অনুসরণ করা না হয় তবে প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url