OCD : বাধ্যতাধর্মী বাতিক বৈকল্যের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা
Obsessive compulsive Disroder - কে সংক্ষেপে OCD বলা হয়। OCD এক ধরনের দুশ্চিন্তামূলক বৈকল্য। এ বৈকল্যে ব্যক্তির কোনো বিশেষ চিন্তা বা ক্রিয়ার অধীনে বশবর্তী হয়ে পড়ে। ব্যক্তি অহেতুকভাবে কোনো বিশেষ ক্রিয়া পুনঃপুন সম্পাদন করতে বাধ্য হয় না কোনো বিশেষ চিন্তা বারবার মনে পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়।
চিন্তা (Obsession): Obsession হচ্ছে এমন এক ধরনের প্রতিক্রিয়া যা অবাস্তব ও অযৌক্তিক কিন্তু চেতনায় বদ্ধমূল হয়ে আছে। তবে এটা অনিয়ন্ত্রিত ও অযৌক্তিক চেষ্টা করেও ব্যক্তি স্বাভাবিক হতে পারে না। এই চিন্তার কারণে সে দৈনন্দিন কাজ ঠিকমতো করতে পারে না।
কাজ (Compulsion): এক্ষেত্রে ব্যক্তি বাধ্যতামূলকভাবে একই কাজ বারবার করে এবং এটা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। বাধ্যতাধর্মী কাজের এই পৌনঃপুনিকতাকেই Compulsion বলে।
সাধারণ কথায় বাধ্যবাধকতামূলক প্রতিক্রিয়া বলতে শুচিবাইকেই বোঝানো হয়। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড এটিকে অবচেতন মনের এক বিশেষ আর্তনাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ রোগে রোগীরা কোনো একটি কাজ বারবার করতে থাকে। এরূপ কাজটি বারবার করার পেছনে কোনো বাস্তব যুক্তিযুক্ত কারণ না-থাকলেও তা তারা করতে চায়। কাজটি বারবার করতে চায় এবং কাজ করতে না- পারলে তাদের মধ্যে অস্বস্তি পরিলক্ষিত হয়। কাজটি করার পর পরই পরিতৃপ্তি ঘটে।
ব্যক্তির মধ্যে অস্বাভাবিক চিন্তা কাজ করে এবং অস্বাভাবিক আচরণ বার বার করতে চেষ্টা করে। চেষ্টা করেও ব্যক্তি স্বাভাবিক হতে পারে না। সাধারণত ২%-৩% মানসিক রোগী এটিতে ভুগছে। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এটা বেশি দেখা যায়। (Golding and Karno, 1991)
Early adulthood-এর আগে পুরুষদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায়। এদের checking compulsion বেশি হয়; যেমন: ঘরের দরজা বন্ধ কিনা, লাইট বন্ধ কিনা প্রভৃতি ৬-৭ বার গিয়ে দেখে এমন ঘটনাও আছে। আর মেয়েদের এই রোগ হলে তাদের মধ্যে cleaning compulsion বেশি দেখা যায়; যেমন হাত বারবার ধোয়া, যে কোনো জিনিস বারবার পরিষ্কার করা।
OCD রোগীদের মধ্যে বিষণ্ণতা দেখা দেয়। এছাড়া OCD হলে অন্যান্য Anxiety disorder (Phobia, Panic, disorder) দেখা যায়। এছাড়াও যারা Personality disorder-এ ভোগে তাদের OCD দেখা দেয়।
বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ
১. পুনঃপুন কাজ সংগঠন: বাতিকগ্রস্ত রোগীরা কতকগুলো কাজ বা চিন্তা বারবার করে থাকে। এ রোগীরা কোনো কাজ বা কোনো একটি চিন্তাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। যে চিন্তাটি রোগীকে আহত করে সে চিন্তাটিকে রোগী কোনো অবস্থাই মন থেকে দূর করতে পারে না।
২. বদ্ধমূল ধারণা: এসব রোগীর মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা কাজ করে। তারা কোনো একটি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে ভয় পায়। তাছাড়া, তাদের স্বভাব হলো একগুঁয়ে ও রীতিসিদ্ধ।
৩. পরস্পর-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী: এসব রোগী ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি দুইটি পরস্পর-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি একসাথে পোষণ করে। যেমন, ভালোবাসা ও ঘৃণা।
৪. নেতিবাচক মনোবৃত্তি: হিংসাত্মক এবং আক্রমণাত্মকভাব কথায় ও আচরণে প্রবলভাবে দেখা যায়। এসব রোগী মনে করে যদি কেউ কোনো কথা মুখে বলে তবে তা হুবহু ঘটে যায়। যেমন, রাগ করে মা যদি ছেলেকে বলেন 'মর তুই'। পরমুহূর্তেই মায়ের মধ্যে চিন্তা ঢুকবে কথাটা যখন মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল তখন ছেলে আমার মরবে। এসব রোগী সবসময় সংশয় ও অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে। তবে এসব রোগী বিবেকবান, সহ্যশীল, লাজুক প্রকৃতির ও বুদ্ধিসম্পন্ন।
৫. নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি: এসব রোগী নিরাপত্তার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এসব রোগী অন্যদের কাছ থেকে নির্ভুল ও নিখুঁত প্রত্যাশা করে। এজন্য লোকজন এদের থেকে দূরে থাকতে চায়। এরা অনেকটা রসকসহীন। এসব রোগী অন্তর্মুখী ও আত্মকেন্দ্রিক এবং নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকে।
বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ার কারণ:
বিভিন্ন কারণে বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। নিম্নে এর কয়েকটি কারণ বর্ণনা করা হলো:
১. পরিবর্তিত চিন্তা বা কাজ: কোনো বিশেষ চিন্তা বা কাজের পরিবর্তে অন্য কোনো চিন্তা বা কাজ সম্পন্ন করা এই নিউরোসিসের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়। যখন কোনো বিপজ্জনক চিন্তা বা কাজ বাধ্যতামূলকভাবে ব্যক্তির মধ্যে দেখা দেয় তখন দুশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য ব্যক্তি অন্য একটি চিন্তা বা কাজ সম্পন্ন করে, যেমন, কোনো একটি বিশেষ ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তির মধ্যে অক্ষমতা বা ব্যর্থতার অনুভূতি দেখা দেয় তখন সে অন্য কোনো ক্ষেত্রে অতীতে লাভ করা তার সাফল্যের কথা বরাবার চিন্তা করে নিজেকে রক্ষা করে।
২. অবদমিত ইচ্ছা: ব্যক্তির অবদমিত ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে অনেক সময় বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এক ব্যক্তির স্ত্রী তার তিন বছরের সন্তানের মাথায় হাতুড়ি মারার তীব্র ইচ্ছাবোধ করল। কিন্তু সে তার এ ভয়াবহ ইচ্ছার কোনো কারণ খুঁজে পেল না। পরবর্তী সময়ে সে বিশ্লেষণ করে দেখতে পেল যে, তার স্ত্রী ঐ সন্তানের জন্মের সময় ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। এমনকি তার স্ত্রী' পুনরায় সন্তানবতী হওয়ার ভয়ে তাকে যৌনমিলন করতে দিত না।
৩. প্রতিক্রিয়া সংগঠন: প্রতিক্রিয়া সংগঠন নামক প্রতিরক্ষা-কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ বাধ্যবাধকতামূলক প্রতিক্রিয়ার আরেকটি কারণ। এজন্যই যে বিপজ্জনক চিন্তা বা আচরণ করতে রোগীর ইচ্ছা সে ঠিক তার বিপরীত চিন্তা বা আচরণ সম্পন্ন করে; যেমন- ব্যক্তি তার অন্তর্নিহিত শত্রুতার অনুভূতি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তীব্রভাবে অপরকে ভালোবাসার কথা চিন্তা করে।
৪. অপরাধবোধ: আত্মধিক্কার কোনো নিষিদ্ধ কাজ বা গর্হিত ইচ্ছার জন্য অপরাধবোধ ও আত্মধিক্কার থেকে অনেক সময় বাধ্যতামূলক চিন্তা ও আচরণের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এরূপ বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে অমার্জনীয় চিন্তা ও আচরণের জন্য ব্যক্তির মনে সাধারণত তীব্র শাস্তির ভীতি থাকে; যেমন- স্বামীকে অন্যায়ভাবে অবহেলা এবং তার প্রতি অবিশ্বস্ততার জন্য এক মহিলার মনে তীব্র অপরাধবোধ দেখা দেয়। এ থেকে তার মধ্যে বাধ্যতাধর্মী চিন্তা ও আচরণের সৃষ্টি হয়।
৫. অবদমিত যৌনকামনা: বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ হলো অবদমিত যৌনকামনা। এ সম্পর্কে মনঃসমীক্ষক ফ্রয়েড বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রে অবদমিত যৌনকামনা থেকে বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে'। যেমন- হস্তমৈথুন করার সময় ধরা পড়ে গিয়ে কোনো ছেলে যদি শৈশবে অকথ্য অত্যাচারের শিকার হয়ে থাকে তাহলে পরবর্তীকালে এরূপ নোংরা কাজ হাত দিয়ে করেছিল বলে সে বারবার হাত ধুয়ে পরিষ্কার করতে চাইবে।
৬. অতিমাত্রায় অনুশাসন: বাল্যকালে যেসব শিশুকে লালন-পালনের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মনীতি, কর্তব্যবোধ প্রভৃতি বিষয়ের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব প্রদান করা হয় সেসব শিশু বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ায় ভোগে।
৭. উদাসীন মনোভাব: শিশুরা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। এ সময় তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। কিন্তু শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে পিতামাতার উদাসীন মনোভাব শিশুদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে এসব শিশু পরবর্তী সময়ে বাতিকগ্রস্ত হতে পারে।
৮. বলবৃদ্ধি: পাওয়া আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীরা বাধ্যতাধর্মী বিকৃতি বা প্রতিক্রিয়াকে শিক্ষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা মনে করেন, মানুষের কিছু আচরণ বলবৃদ্ধি পাওয়ার দরুন বা পুরস্কৃত হওয়ার দরুন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এক ধরনের বলবৃদ্ধি হলো ভয়ের লাঘব হওয়া; যেমন কোনো ব্যক্তি রোগ সংক্রমণের ভয়ে ভীত অর্থাৎ যার মন থেকে রোগাক্রান্ত হওয়ার চিন্তা দূর হয় না, সে এ চিন্তাটি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই বারবার হাত ধৌত করে; অর্থাৎ হাত ধোয়ার কাজটির মাধ্যমে সে রোগাক্রমণের ভয় থেকে মুক্তি পেতে চায়। এ মুক্তি পাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়াটাই হলো বলবৃদ্ধি। এভাবে বলবৃদ্ধির কারণে ব্যক্তির মধ্যে বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির বা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
৯. নেতিবাচক চিন্তা: অতিমাত্রায় নেতিবাচক চিন্তার কারণে মানুষের মধ্যে বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির সৃষ্টি হয়; যেমন- গাড়ি চালানোর সময় দুর্ঘটনা ঘটবে বলে চিন্তা করা। অনেক গবেষক বলেছেন, মানুষ যখন পীড়ন বা চাপের সম্মুখীন হয়, তখন তার এ ধরনের চিন্তা বেড়ে যায়। কিন্তু সাধারণ লোকেরা যখন এসব চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলতে পারে তখন বাধ্যতাধর্মী চিন্তার রোগীদের ক্ষেত্রে এসব চিন্তা খুব প্রবল হয় এবং ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ পায়।
১০. মস্তিষ্কের ক্ষতি: মস্তিষ্কে প্রদাহ, আঘাত ইত্যাদি অসুস্থতার কারণে বাধ্যতাধর্মী বিকৃতি ঘটে। এসব আঘাতের ফলে মস্তিষ্কের দুটি অঞ্চল, যথা-কটেক্সের সম্মুখভাগ এবং ব্যাসেল গ্যাংলিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে ব্যক্তির মধ্যে বাধ্যতাধর্মী বিকৃতি বা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
১১. বংশগতির প্রভাব: অনেক মনোবিজ্ঞানী বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির পেছনে বংশগতির প্রভাবকে দায়ী করেছেন। মনোবিদ ম্যাককিগুন ও মারে এক গবেষণায় দেখতে পান যে, বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির রোগীদের নিকট আত্মীয়দের মধ্যে উদ্বেগজনিত বিকৃতি বেশি দেখা যায়। লিনেন ও তার সঙ্গীরা এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, যাদের বাধ্যতাধর্মী বিকৃতি আছে তাদের নিকটাত্মীয়দের ৩০% লোকের মধ্যে এ বিকৃতি দেখা যায়।
বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ার চিকিৎসা
বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়াগ্রস্তদের চিকিৎসার জন্য তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয় না। এসব রোগীকে মনোচিকিৎসা, আচরণ-চিকিৎসা ও মক্কেল কেন্দ্রিক (Client Centred) চিকিৎসা-পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা যায়। এজন্য একজন মনঃসমীক্ষক বা চিকিৎসক নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন; যথা:
১. এসব রোগীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে।
২. শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার সাহায্যে তাদের আচরণের ভুল-ত্রুটি দূর করতে হবে।
৩. অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতিতে রোগীর অন্ত্রযন্ত্র ও অবচেতন ইচ্ছা উদ্ঘাটন করতে হবে এবং এর প্রতিকার করতে হবে।
৪. এসব রোগীর অন্তর্দৃষ্টি বৃদ্ধি করতে হবে।
৫. এসব রোগীর ব্যক্তিত্বের ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলোর পরিবর্তন করে তাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে সমাজ অনুমোদিত গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে।
৬. বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়াগ্রস্তদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিশেষ: পরিশেষে বলা যায় যে, বাধ্যতামূলক আচরণ কেবল অপরাধবোধমূলক আচরণ থেকেই প্রকাশ পায় না। এর পেছনে অন্যান্য কারণও জড়িত। যাদের মনে বিভিন্ন অপরাধমূলক প্রবণতা বা মনোভাব আছে যদিও তারা অপরাধ করেনি এরূপ ক্ষেত্রেও ব্যক্তির মধ্যে বাধ্যতামূলক আচরণ বিকাশ লাভ করতে পারে। এটা মূলত অবদমনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তবে এ প্রতিক্রিয়া প্রতীকগতভাবেও আসতে পারে।