গবেষণা নকশা : উপযুক্ত উদাহরণসহ উপাদানভিত্তিক নকশা

পরীক্ষণ নকশা একটি উদ্যোগমূলক ও সৃজনশীল কাজ। কোনো বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষণমূলক নকশা প্রণয়ন করা হয়। আর এ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য পরীক্ষককে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অগ্রসর হতে হয়। পরীক্ষক গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নকশা প্রণয়ন করেন। ফলে নকশার ধরনে ভিন্নতা দেখা যায়। মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের নকশার ভিতর অন্যতম প্রধান একটি নকশা হলো উপাদানভিত্তিক নকশা, যা পরীক্ষণের ক্ষেত্রে অনির্ভরশীল চল অনুসন্ধানের নকশা।

উপাদানভিত্তিক নকশা:

যে নকশায় মাত্র একটি পরীক্ষণে একাধিক অনির্ভরশীল চল এবং প্রতি চলের একাধিক মাত্রা বা মূল্যমানের প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করা হয় তাকে উপাদানভিত্তিক নকশা বলে। মনোবিজ্ঞানী ম্যাকগুইগানের মতে, "যখন কোনো একটি পরীক্ষণে দুই বা ততোধিক অনির্ভরশীল চলের নির্ধারিত শর্তগুলোর সকল সম্ভাব্য সমন্বয়ে অনুসন্ধান করা হয়, তখন উপাদানভিত্তিক নকশা ব্যবহার করতে হয়।" এই নকশায় নির্ভরশীল চলের ভেদাঙ্ক বিশ্লেষণে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। যথা- ১. নির্ভরশীল চলের উপর অনির্ভরশীল চলের প্রভাব, ২. দুই বা ততোধিক অনির্ভরশীল চলের পারস্পরিক ক্রিয়া। উপাদানভিত্তিক নকশায় বিভিন্ন ধরনের অনির্ভরশীল চলের প্রভাবের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য ভেদাঙ্ক বিশ্লেষণ পদ্ধতির সাহায্য নিতে হয়। এ নকশা অনুসরণ করেই মনোবিজ্ঞানী প্যাভলভ সাপেক্ষীকরণের সূত্রাবলি আবিষ্কার করেছেন। উপাদানভিত্তিক নকশা থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে, উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে মাত্র একজন পরীক্ষণপাত্রকে নিয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষণকার্য পরিচালনা করা সম্ভব। 

উদাহরণ: মনোবিজ্ঞান গবেষক হারলি এবং হারলি শিক্ষণের উপর হিপনোসিসের প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করেন। তাদের পরীক্ষণের সমস্যা ছিল ৩টি প্রশ্নের উত্তর গ্রহণ করা। প্রশ্নগুলো হলো- ১. সম্মোহিত অবস্থা শিক্ষণকে প্রভাবিত করে কি-না। ২. সম্মোহিত হওয়ার প্রবণতা শিক্ষণকে প্রভাবিত করে কি-না। ৩. সম্মোহনের মাত্রা ও সম্মোহন প্রবণতা পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত কি-না। উপরিউক্ত ৩টি প্রশ্নের উত্তরের জন্য তারা উপাদানভিত্তিক নকশা প্রয়োগ করেন। তারা সম্মোহনের মাত্রাকে ২ ভাবে পরিবর্তন করার চিন্তা করেন। যেমন- ১. সম্মোহিত অবস্থা ও ২. অসম্মোহিত অবস্থা। আবার তারা সম্মোহিত অবস্থারও ২টি মাত্রা নির্ধারণ করেন।

যেমন- ক. কম সম্মোহিত অবস্থা ও খ. বেশি সম্মোহিত অবস্থা। এভাবে তাদের পরীক্ষণে ৪টি পরীক্ষণমূলক অবস্থা সৃষ্টি হয়। যথা-১. সম্মোহিত ও কম সম্মোহিত অবস্থা, ২. সম্মোহিত নয় ও কম সম্মোহিত অবস্থা, ৩. সম্মোহিত ও বেশি সম্মোহিত অবস্থা, ৪. সম্মোহিত নয় ও বেশি সম্মোহিত অবস্থা। তারা প্রতি দলে ৮ জন কওে মোট (৪০৮) ৩২ জন পরীক্ষণপাত্র ব্যবহার করেন। নিম্নে পরীক্ষণের নকশাটি দেখানো হলো:

সম্মোহনের মাত্রা :  

সম্মোহন প্রবণতা, সম্মোহিত, সম্মোহিত নয়

কম,    ১,     

বেশি,    ৩,     

ভেদাঙ্ক বিশ্লেষণের (f-অনুপাত) ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, সম্মোহিত অবস্থা শিক্ষণকে ব্যাহত করে। সম্মোহন প্রবণতার পার্থক্য শিক্ষণের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করে না এবং সম্মোহন প্রবণতা ও সম্মোহিত অবস্থার মধ্যে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য নেই।

উপাদানভিত্তিক নকশার বৈশিষ্ট্য: 

১. একাধিক চলের প্রভাব নির্ণয়: উপাদানভিত্তিক নকশার সাহায্যে এক সাথে একাধিক চলের প্রভাব নির্ণয় করা যায়। কারণ এ নকশাটি মূলত পরীক্ষণে একের অধিক অনির্ভরশীল চলের প্রভাব নির্ণয়ের জন্যই প্রণীত হয়েছে। অর্থাৎ এ নকশায় একাধিক অনির্ভরশীল চলের প্রভাব নিয়ে কাজ করা হয়। যেমন- আচরণের উপর শান্তির তীব্রতা ও শাস্তির সময়ের প্রভাব আছে কি-না তা নির্ণয় করা হলো উপাদানভিত্তিক নকশার উদাহরণ।

২. একাধিক অনির্ভরশীল চলের ব্যবহার: উপাদানভিত্তিক নকশায় একই সাথে একাধিক অনির্ভরশীল চলের ব্যবহার করা হয়, যা সাধারণত অন্যান্য নকশায় করা হয় না। এসব অনির্ভরশীল চলের একাধিক মানও থাকে, যার প্রভাবও দেখা হয়। যেমন- কোনো বিষয় মনে রাখার ক্ষেত্রে একাধিক অনির্ভরশীল চল ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো তথ্য মনে রাখার ক্ষেত্রে তথ্যের পরিমাণ কতটা ও মৌখিক প্রকাশের প্রভাব দেখা হয়। এখানে দুটি অনির্ভরশীল চল ব্যবহার করা হয়।

৩. চলেয় সম্পর্ক নির্ণয়: উপাদানভিত্তিক নকশার সাহায্যে অনির্ভরশীল চলের সাথে নির্ভরশীল চলের কিরূপ সম্পর্ক আছে তা নির্ণয় করা যায়। এছাড়াও এ নকশাটি অনির্ভরশীল চলের বিভিন্ন মানের মাথে নির্ভরশীল চলের সম্পর্ক আবিষ্কারেও সহায়তা করে। আচরণের সাথে শাস্তির তীব্রতা ও শাস্তির সময় কি পরিমাণে সম্পর্কিত বা আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি-না তা এ নকশার সাহায্যে দেখা হয়।

৪. বহুদলের ব্যবহার: উপাদানভিত্তিক নকশায় একই সাথে অনেকগুলো দল ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ একই সাথে অনেকগুলো দলের উপর পরীক্ষণ করা হয়। ফলে নির্ভরশীল চলের উপর কোনো দলগত পার্থক্যের প্রভাব আছে কি-না তা ব্যাখ্যা করা যায়।

৫. কার্যকর নকশা: উপাদানভিত্তিক নকশা একটি কার্যকর নকশা হিসেবেও বিশেষভাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কারণ এ নকশায় একাধিক অনির্ভরশীল চলের প্রভাব নিরূপণ করা হয়, যা অন্যান্য নকশায় করা হয় না। অতএব এটি গবেষণায় অত্যন্ত উপযাগেী।

উপাদানভিত্তিক নকশার সুবিধাসমূহ:

১. চলের প্রভাব: উপাদানভিত্তিক নকশার সাহায্যে এক সাথে একাধিক চলের প্রভাব নির্ণয় করা যায়। কারণ এ নকশা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একাধিক অনির্ভরশীল চলের প্রভাব নির্ণয়ের জন্য প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এ নকশার দ্বারা একাধিক অনির্ভরশীল চলের প্রভাব নিয়ে কাজ করা হয়।

২. মাত্রাগত সম্পর্ক: উপাদানভিত্তিক নকশার সুবিধা হলো মাত্রাগত সম্পর্ক নির্ণয় করা। অর্থাৎ এই নকশার সাহায্যে একটি অনির্ভরশীল চলের বিভিন্ন মাত্রার সাথে নির্ভরশীল চলের কি ধরনের সম্পর্ক রয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে অনুসন্ধান করা যায়। 

৩. পারস্পরিক সম্পর্ক: উপাদানভিত্তিক নকশার আরেকটি সুবিধা হলো পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করা। অর্থাৎ দুই বা ততোধিক অনির্ভরশীল চলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে কি-না, তা নির্ণয় করা। 

৪. বহুদলের ব্যবহার: উপাদানভিত্তিক নকশার আরেকটি সুবিধা হলো বহৃদলের ব্যবহার। অর্থাৎ এ নকশার একই সাথে অনেকগুলো দল ব্যবহার ও পরীক্ষণ করা হয়।

৫. দলগত পার্থক্যের প্রভাব: উপাদানভিত্তিক নকশায় দলগত পার্থক্যের প্রভাব যাচাই করা হয়। অর্থাৎ এ নকশায় বহুল ব্যবহৃত হয় বলে নির্ভরশীল চলের উপর দলগত পার্থক্যের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়। 

৬. পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণ: উপাদানভিত্তিক নকশায় বিভিন্ন ধরনের অনির্ভরশীল চলের প্রভাব সম্পর্কে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য ভেদান্ত বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ভেদাঙ্ক বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপাদানভিত্তিক নকশার তথ্যের গাণিতিক বিশ্লেষণ করা হয়।

৭. সাপেক্ষীকরণের সৃষ্টি: উপাদানভিত্তিক নকশার অন্যতম সুবিধা হলো সাপেক্ষীকরণ সৃষ্টি। এ নকশা অনুসরণ করেই মনোবিজ্ঞানী প্যাভলভ সাপেক্ষীকরণের সূত্র আবিষ্কার করেছেন।

৮. পরীক্ষণকার্য পরিচালনা: উপাদানভিত্তিক নকশার সাহায্যে পরীক্ষণকার্য পরিচালনা করা হয়। এই নকশার সাহায্যে প্রমাণিত হয় যে, উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে একজনমাত্র পরীক্ষণ পাত্রকে নিয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষণকার্য পরিচালনা করা সম্ভব।

উপাদানভিত্তিক নকশার অসুবিধাসমূহ:

১. চল ব্যবহারে জটিলতা: উপাদানভিত্তিক নকশায় চল ব্যবহারে জটিলতার সৃষ্টি হয়। কেবল একটি পরীক্ষণে একাধিক অনির্ভরশীল চল ব্যবহার করা হয় বলে এ নকশায় চল ব্যবহার সংক্রান্ত জটিলতার উদ্ভব হতে পারে।

২. সময়সাপেক্ষ: উপাদানভিত্তিক নকশা সময়সাপেক্ষ। অর্থাৎ একাধিক অনির্ভরশীল চলের একাধিক মাত্রার প্রভাব জানা হয় বলে বেশি সময় লাগতে পারে।

৩. নকশা নির্বাচনে জটিলতা: উপাদানভিত্তিক নকশায় নকশা নির্বাচনে জটিলতা সৃষ্টি হয়। যেহেতু এ নকশার ধরন/শ্রেণিবিভাগ বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় সেহেতু পরীক্ষণ পরিকল্পনা অনুযায়ী উপযুক্ত নকশাটি নির্বাচন করা অনেক সময় কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। 

৪. পরীক্ষকের দক্ষতা: উপাদানভিত্তিক নকশার আরেকটি অসুবিধা হলো পরীক্ষকের দক্ষতা। অর্থাৎ খুব বেশি পরিমাণে দক্ষ পরিক্ষক ছাড়া এ পরীক্ষণ পরিচালনা করা অসম্ভব। এছাড়া সবসময় দক্ষ পরীক্ষক খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

৫. মানের পরিবর্তন: উপাদানভিত্তিক নকশায় অনির্ভরশীল চলের যেসব মান ব্যবহৃত হয় সেগুলো বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তিত হয়। কোনো কোনো অনির্ভরশীল চলের দুটি মাত্রা, কোনাটির তিনটি মাত্রা আবার কখনো তারও বেশি মাত্রা ব্যবহৃত হয়। তাই মানের পরিবর্তন পরীক্ষণের নতুন সমস্যার সৃষ্টি করতে সহায়তা করে।

৬. নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: উপাদানভিত্তিক নকশার অন্য একটি অসুবিধা হলো যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষণকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নাও হতে পারে। 

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, যখন কোনো পরীক্ষণে দুই বা ততোধিক অনির্ভরশীল চলের নির্বাচিত মাত্রাগুলোর প্রভাব সকল সম্ভাব্য সমন্বয়ে অনুসন্ধান করা হয়, তখন উপাদানভিত্তিক নকশা ব্যবহার করতে হয়। উপাদানভিত্তিক নকশা হলো একই পরীক্ষণে দুই বা ততোধিক অনির্ভরশীল চলের প্রভাব অনুসন্ধানের একটি সম্ভাব্য নকশা। এ নকশার সাহায্যে একটি পরীক্ষণে একাধিক অনির্ভরশীল চল ও বিভিন্ন চলের একাধিক মাত্রার বা মূল্যমানের প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করা যায়। নকশা নির্ধারণ সঠিক না হলে উপাত্ত সংগ্রহ ও ব্যাখ্যা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url