ডারউইনের বিবর্তনবাদ

দর্শনের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হয়ে বিজ্ঞান হিসাবে মনোবিজ্ঞানের বিকাশলাভের ক্ষেত্রে ডারউনের বিবর্তনবাদ তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রাখে। 

ইংরেজ প্রকৃত বিজ্ঞানী চার্লস রবার্ট ডারউইন ১৮৫৯ সনে "Orgin Of Species" গ্রন্থে জীবের সৃষ্টি ও বিবর্তন সম্বন্ধে একটি বৈপ্লবিক মতবাদ উপস্থাপন করেন। এই মতবাদটি বিবর্তনবাদ বা প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ নামে পরিচিত।

বিবর্তনবাদ

বিবর্তন বা অভিব্যাক্তি হলো এমন একটি জীববৈজ্ঞানিক ধারণা যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবের গাঠনিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমপরিবর্তনকে বুঝায়। কোনো জীবের বংশধরদের মাঝে যে জিনরাশি ছড়িয়ে পড়ে তারাই বংশপ্রবাহে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে।

ডারউইনের বিবর্তনবাদের মূল বিষয়গুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো:

১. অত্যধিক জন্মহার: 

প্রকৃতিতে বিভিন্ন জীব যে সংখ্যক সাধারণ অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক সন্তান উৎপাদন করে। ডারউইনের আগে ক্যারোলাস লিনিয়াসও এই বিষয়টি লক্ষ করেন। জীবের বংশবৃদ্ধি গুণোত্তর প্রগতি অনুযায়ী চলতে থাকে। ফলে, বাঁচার সম্ভাবনাসম্পন্ন জীব অপেক্ষা সৃষ্ট জীবের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। একটি স্যালমন মাছ এক প্রজনন ঋতুতে ২৮০ লক্ষ ডিম পাড়তে পারে। যেসব প্রজাতির জন্মহার অধিক তাদের অধিকাংশ প্রজাতি খুব ছোটো অবস্থায় মারা যায়।

২. সীমিত খাদ্য ও বাসস্থান: 

জীবের অত্যধিক বংশবৃদ্ধির কারণে তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য ও বাসস্থানের অভাব দেখা দেয়।

৩. বেচে থাকার সংগ্রাম: 

জন্মহার অধিক হলেও পৃথিবীতে খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত। এজন্য বেচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন জীবকে খাদ্য, জল, আলো ইত্যাদির জন্য সংগ্রাম করতে হয়। ডারউইন এই সংগ্রামকে 'জীবন-সংগ্রাম' নামে অভিহিত করেছেন। 

তার মতে এই বেচে থাকার সংগ্রাম তিন প্রকার:

  • অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম: একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে এই সংগ্রাম দেখা দেয়: যেমন- মানুষে মানুষে সংগ্রাম। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা বেশি দেখা যায় একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে। কারণ তাদের সকল সদস্যের খাদ্য, আলো-বাতাস ইত্যাদির প্রয়োজন একই রকম।
  • আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম: ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যেও এই সংগ্রাম দেখা দেয়। যেমন- মানুষ ও বন্য প্রাণীদের মধ্যে সংগ্রাম।
  • পরিবেশগত সংগ্রাম: কখনও কখনও পরিবেশের সাথে জীবের সংগ্রাম দেখা দিতে পারে, তখন তাকে পরিবেশগত সংগ্রাম বলে; যেমন- শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বন্যা, ভূমিকম্প, খরা প্রভৃতির বিরুদ্ধে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

৪. পরিবৃত্তি বা প্রকরণ (Variation): 

প্রতিটি প্রজাতির দুটি প্রাণী কখনোই এক রকম হয় না, সব সময় কিছু না কিছু পার্থক্য থাকে। একে ডারউইনের মতে পরিবৃত্তি বলে। তার মতে, অবিরাম সংগ্রামের ফলে শারীরিক পরিবর্তনের কারণে পরিবৃত্তির উদ্ভব হয় এবং তা বংশানুক্রমে পরিচালিত হয়ে জীবের বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দেয়। পরিবৃত্তি দুই ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এই প্রভাবের উপর ভিত্তি করে পরিবৃত্তিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়; যথা- অনুকূল পরিবৃত্তি এবং প্রতিকূল পরিবৃত্তি। যেসব পরিবৃত্তি জীবের অভিযোজনে এবং বেঁচে থাকাতে সহায়তা করে সেগুলোকে অনুকূল পরিবৃত্তি বলে। আবার যেসব পরিবৃত্তি জীবের অভিযোজন এবং বেঁচে থাকাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেগুলোকে প্রতিকূল পরিবৃত্তি বলে।

ডারউইন আরো দুই রকমের পরিবৃত্তির কথা উল্লেখ করেন; যথা- বিচ্ছিন্ন পরিবৃত্তি এবং অবিচ্ছিন্ন পরিবৃত্তি। যেসব পার্থক্যসমূহ হঠাৎ বা আকস্মিকভাবে দেখা দেয় সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন পরিবৃত্তি বলে। এরকম পরিবৃত্তিকে ডারউইন Sports নামে আখ্যায়িত করেন। বিবর্তনের ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিবৃত্তির তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। বিচ্ছিন্ন পরিবৃত্তির ফলে ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্যগুলো হঠাৎ দেখা দেয়- সেজন্য প্রকৃতি এগুলোকে নির্বাচন করে না। আবার, যেসব পার্থক্য ধারাবাহিকভাবে সংগঠিত হয় সেগুলোকে অবিচ্ছিন্ন পরিবৃত্তি বলে। ডারউইন মনে করেন, অবিচ্ছিন্ন পরিবৃত্তি বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এক্ষেত্রে স্বল্প পরিবর্তন হওয়ায় প্রকৃতি সুবিধাজনক পরিবৃত্তিটি বেছে নেয়। এভাবে ক্রমশ ধীরে ধীরে পরিবর্তন চলতে থাকে। এগুলো সাধারণত ক্ষতিকারক হয় না। ক্ষতিকারক হলে এগুলো শুরুতে বাতিল হয়ে যায়। ডারউইনের মতে, জিরাফের দীর্ঘ গ্রীবা অবিচ্ছিন্ন পরিবৃত্তি এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে সৃষ্টি হয়ছে।

৫. প্রাকৃতিক নির্বাচন: 

জীবের বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া একটি দৈবচয়ন-প্রক্রিয়া। আগে থেকে বোঝার উপায় নেই কোন পরিবর্তন ইতিবাচক, কোনটি নেতিবাচক এবং কোনটি নিরপেক্ষ হবে। পরিবর্তনটি যদি নেতিবাচক বা প্রতিকূল পরিবৃত্তির হয় তাহলে সেই প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ- কোনো বন্য পোকার গায়ের রং নির্ধারণকারী জিন যদি এমনভাবে পরিবর্তন হয়ে যায় যে এর গায়ের রং বনের লতাপাতা বা গাছপালার রঙের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে যায়, যেটা সহজে খাদক শিকারি প্রাণীর চোখে পড়ে, তাহলে শিকারির পাল্লায় পড়ে সে আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে চলে যায়। অন্যদিকে, পরিবর্তনটি যদি ইতিবাচক বা অনুকূল পরিবৃত্তি হলে প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। জিনটি যদি এমনভাবে পরিবর্তন হতো যে পোকাটির গায়ের রং বনের অন্যান্য গাছপালার রঙের সাথে মিশে যেত যাতে। পোকাটিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ত, তাহলে পোকাটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যেত। আর এভাবে নতুন। জিনটি বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে যাবে। ডিএনএ-এর মাঝে জিনের দৈব-পরিবর্তনে বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করার জন্য উপকারী জিনটিকে নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটিকে বলে প্রাকৃতিক নির্বাচন।

ডিএনএ পরিবর্তনের ব্যাপারটি র‍্যান্ডম হলেও অনেকগুলো র‍্যান্ডম পরিবর্তন থেকে দরকারি উপকারী জিনটি খুব যত্ন করে নির্বাচন করে প্রাকৃতিক নির্বাচন। এর মানে হচ্ছে, কোন জিনটি জীবদেহে বংশানুক্রমিকভাবে প্রবাহিত হবে সেটি খুব সতর্কভাবে ঠিক হয়। আর এভাবে জীবের বিবর্তন ঘটে আরো অধিকতর শক্তিধর শারীর তৈরির দিকে, দুর্বল বা অপ্রয়োজনীয় অঙ্গগুলি আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয় বা বিলুপ্ত হয়।

৬. যোগ্যতমের টিকে থাকা: 

জীবন-সংগ্রামে অনুকূল পরিবৃত্তিতে জীব টিকে থাকে এবং বংশবিস্তার করে। প্রকৃতির প্রতিবন্ধকগুলোকে সম্পূর্ণরূপে জয় করে অনুকূল পরিবৃত্তি বিশিষ্ট জীবসমূহ জীবন-সংগ্রামে বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে। প্রতিকূল পরিবৃত্তিসম্পন্ন জীবসমূহ জীবন-সংগ্রামে হেরে গিয়ে কালক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

উপসংহার: 

ডারউইনের মতবাদ অনুসারে মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী। বেঁচে থাকার তাগিদে প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ বর্তমান রূপ লাভ করেছে। অতএব মানুষ তার সকল স্বভাব উত্তরাধিকার সূত্রে তার পুর্বপুরুষ প্রাণীর কাছ থেকে লাভ করেছে। একারণে মানুষ ও ইতর প্রাণীর আবেগ, অনুভূতি ও আচরণের মধ্যে অনেক সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়।

বিবর্তন মতবাদের অনেক ভুল ক্রুটি থাকা সত্ত্বেও ডারউইনের এই মতবাদ জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং বিবর্তনবাদ দ্বারা মনোবিজ্ঞানীদের চিন্তাধারা গভীরভাবে প্রভাবিত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url