ব্যক্তিত্বের উপর কৃষ্টির প্রভাব

ব্যক্তিত্বের উপর কৃষ্টির প্রভাব

যে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তার কৃষ্টির দ্বারা নির্ধারিত হয়। কৃষ্টি বলতে কোন সমাজের সদস্যদের 'শিক্ষালব্ধ আচরণের ধারা' বুঝায়। চলাফেরা, পোশাক- আশাক, পছন্দ-অপছন্দ সবকিছু মানুষ তার সমাজে প্রচলিত প্রথা অনুসারে করে থাকে। তবে কৃষ্টি শুধুমাত্র সামাজিক প্রথা নয়। পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন, মনোভাব, বিশ্বাস, রীতি-নীতি, মূল্যবোধ সবই কৃষ্টির অন্তর্গত। 

অর্থাৎ কৃষ্টি মানুষের আচরণের একটি সামগ্রিক রূপ। জীবন যাপনের বিভিন্ন উপাদানকে একসূত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গ্রথিত করে যে জীবন ধারা গড়ে ওঠে তারই নাম কৃষ্টি। বংশ পরম্পরায় এই ধারাটি প্রবহমান থাকে বলে কৃষ্টির অপর নাম সামাজিক উত্তরাধিকার। তবে সময়ের সাথে সাথে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয় বলে কৃষ্টিরও পরিবর্তন হয়।

কৃষ্টির সুপ্ত ও ব্যক্ত এই দুটি রূপ রয়েছে। বিশ্বাসের ধারা, কল্পকাহিনী ইত্যাদি সুপ্ত কৃষ্টির মূল উৎস। সামাজিক প্রথা, আনুষ্ঠানিক আচার আচরণ প্রভৃতি ব্যক্ত কৃষ্টির অন্তর্গত। কৃষ্টির এই উভয়রূপই ব্যক্তির আচরণ ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে প্রভৃত প্রভাব বিস্তার করে।

নৃবিজ্ঞানীগণ আদিম মানুষের সামাজিক প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও আচরণের উপর দীর্ঘকাল ধরে গবেষণা করে আসছেন। তাঁদের সংগৃহীত তথ্য থেকে ব্যক্তির উপর কৃষ্টির প্রভাব সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। ব্যক্তিত্বের উপর কৃষ্টির প্রভাব সম্বন্ধে যে সব গবেষক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে মার্গারেট মীড ও রুথ বেনেডিক্ট-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মার্গারেট মীড সামোয়া নামক একটি উপজাতির কিশোরদের উপর অনুসন্ধান পরিচালনা করে দেখতে পান তাদের কিশোরকাল মোটেই মানসিক চাপে ভারাক্রান্ত নয়। তারা পারিবারিক জীবনে সুউপযোজিত এবং যৌন বিষয়ে উদারপন্থী। অপরদিকে নিউগিনির মনু উপজাতির কিশোররা অত্যধিক মানসিক চাপগ্রস্ত। যৌনতার অবদমন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার আকাঙ্ক্ষা, শারীরিক সৌকর্য প্রদর্শন, পরিশ্রমী হওয়া এবং ক্ষমতাবানদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা মানুষের বৈশিষ্ট্য।

অপর একটি গবেষণায় মীড নিউগিনির অ্যারাপ্রেশ, মুন্ডগুমর ও চাম্বুলী নামক তিনটি উপজাতির নারী-পুরুষে স্বভাবগত বৈষম্য ও তার কারণ অনুসন্ধান করেন। এই অনুসন্ধানে দেখা যায়, একই ভৌগোলিক অবস্থায় বসবাস করা সত্ত্বেও তিনটি উপজাতির ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। অ্যারাপ্রেশরা অনাগ্রাসী, সহযোগী, শান্ত ও নম্র স্বভাবের। নারীসুলভ গুণাবলী তাদের আদর্শ। অন্যদিকে মুক্তগুমর নারী-পুরুষেরা পুরুষসুলভ গুণাবলীর পূজারী। তারা আগ্রাসী, নির্দয় এবং যৌনবিষয়ে বাধাবন্ধনহীন। দুইটি উপজাতির স্বভাবের এই বৈপরীত্য ব্যাখ্যা করতে যেয়ে মীড শিশু প্রতিপালনের পার্থক্যের প্রতি নির্দেশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন অ্যারাপ্রেশ মা তার শিশুকে খাওয়ানোর সময় শিশুকে আরামদায়ক অবস্থানে রেখে বেশ অনেকটা সময় ধরে শিশুকে খাওয়ান। অন্যদিকে মুন্ডগুমর মা খুব তাড়াতাড়ি শিশুকে খাওয়ানোর কাজটি সমাধা করেন এবং এ সময় এমন একটি অস্বস্তিকর অবস্থানে শিশুকে রাখেন যাতে করে একরকম যুদ্ধ করে শিশুকে তৃপ্ত হতে হয়। শিশু পালনে এধরনের পার্থক্যের কারণে অ্যারাপ্রেশ ও মুন্ডগুমরদের ব্যক্তিত্ব সংলক্ষণে পার্থক্য সূচিত হয় বলে গবেষক মনে করেন।

চাম্বুলীদের মধ্যে নারী ও পুরুষের ভূমিকা বৈশিষ্ট্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের সমাজে নারীরাই প্রাধান্য বিস্তার করে এবং পুরুষরা নির্ভরশীল প্রকৃতির ও অপেক্ষাকৃত কম দায়িত্বশীল হয়ে থাকে। এইসব পার্থক্য থেকে মীড এই উপসংহারে উপনীত হন যে নারী ও পুরুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে যে ধারণা প্রচলিত তা ভুল। প্রকৃতপক্ষে মানব প্রকৃতি শিশুকালেই কৃষ্টির প্রভাবে গড়ে ওঠে।

মীড-এর ন্যায় বেনেডিক্টও মানুষের আচরণ বিকাশে কৃষ্টির শক্তিশালী প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, জন্মের পরপরই শিশুর উপর এই প্রভাবের সূচনা হয় এবং যে সমাজ বা কৃষ্টিতে সে জন্মলাভ করে তারই প্রচলিত ধারায় তার অভ্যাস, বিশ্বাস- এক কথায় সকল আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। তিনি নিউগিনির ডবু, নিউ মেক্সিকোর জুনি, এবং ভ্যানকুভার দ্বীপের কোয়াকিটল সম্প্রদায়ের কৃষ্টিগত পার্থক্য ও তার প্রভাব সম্বন্ধে অনুসন্ধান করেন। জুনিদের নম্র, ভদ্র ও দ্বিধাদ্বন্দুহীন স্বভাবের বিপরীতে বেনেডিক্ট ডবুদের আক্রমণাত্মক, প্রতিযোগী, সন্দেহপ্রবণ ও বিশ্বাসঘাতকতার মনোভাব লক্ষ্য করেন। আত্মকেন্দ্রিকতা, আত্মগৌরব ও প্রতিযোগিতার মনোভাব ছিলো কোয়াকিটলদের বৈশিষ্ট্য। তিনটি উপজাতির ব্যক্তিত্বের এইসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে বেনেডিক্ট এই উপসংহারে উপনীত হন যে একেক কৃষ্টিতে একেক ধরনের ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য অভিপ্রেত বা অনভিপ্রেত থাকে। কোন কোন কৃষ্টিতে আগ্রাসন, প্রাধান্য, প্রতিযোগিতা প্রভৃতি সংলক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আবার কোন কোন কৃষ্টিতে এর বিপরীত সংলক্ষণগুলো অধিক প্রত্যাশিত বলে বিবেচিত হয়। ব্যক্তির শিক্ষণ এই সামাজিক প্রত্যাশার অনুগামী হয় বলেই বিভিন্ন কৃষ্টিতে ব্যক্তিত্ব সংলক্ষণের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

মীড ও বেনেডিক্ট-এর গবেষণাকে সমালোচকের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করে মনঃসমীক্ষক আব্রাম কার্ডিনার ও নৃবিজ্ঞানী র‍্যাল্‌ল্ফ লিনটন কৃষ্টি ও ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক সম্বন্ধে নতুন কিছু ধারণা দেন। তাঁরা মনে করেন পূর্ববর্তী গবেষণায় কৃষ্টি কিভাবে ব্যক্তির গতিশীল আচরণকে প্রভাবিত করে তার সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়নি। এ ছাড়া আন্তঃকৃষ্টি সংক্রান্ত গবেষণার কোনো সুসংজ্ঞায়িত কৌশলও উদ্ভাবিত হয়নি। তাই বিভিন্ন কৌশল পর্যালোচনা করে মনঃসমীক্ষণকেই তাঁরা একমাত্র উপযোগী মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করেন।

কার্ডিনার ও লিনটন 'মৌলিক ব্যক্তিত্ব কাঠামো' (basic personality structure) বা মৌলিক ব্যক্তিত্বের ধরন (style) বলে একটি ধারণা উত্থাপন করেন। একটি কৃষ্টিতে ব্যক্তিত্বের যেসকল সংলক্ষণ অধিকাংশ ব্যক্তির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের যে দিকগুলো এক কৃষ্টির ব্যক্তিবর্গকে অন্য কৃষ্টির ব্যক্তিবর্গ থেকে পৃথক করে তাকেই তাঁরা মৌলিক ব্যক্তিত্বের ধরন বলে উল্লেখ করেন। বেশ কয়েকটি কৃষ্টির উপর গবেষণা পরিচালনা করে কার্ডিনার এই মত পোষণ করেন যে শিশু প্রতিপালন অর্থাৎ মায়ের যত্ন, মা-বাবার সাথে সম্পর্ক, শাসনের ধরন, ভাই বোনের সম্পর্ক প্রভৃতির মাধ্যমে শিশুর মৌলিক ব্যক্তিত্ব কাঠামো গড়ে ওঠে। এসবের প্রভাবেই শিশুর মৌলিক মনোভাব গড়ে ওঠে যা তার ধর্ম, লোকগীতি, শিল্প প্রভৃতি কৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত হয়। এই ধারণার উদাহরণস্বরূপ তিনি তানালা ও মার্কুইসা নামক দুটি কৃষ্টির পার্থক্য উল্লেখ করেন। তানালা কৃষ্টির ধর্মীয় অনুশাসন তাদের শিশুদের প্রতি পিতামাতার শাসনের প্রতিরূপস্বরূপ। তানালার শিশুকে যেমন জোরপূর্বক বাধ্য ও অনুগত করা হয় তেমনি তানালা ধর্মেও দেবদেবীর প্রতি বাধ্য ও অনুগত থাকার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অপরপক্ষে মাকুইসা কৃষ্টিতে ধর্ম বা পরিবার কোথাও এ ধরনের আনুগত্য বা বাধ্যতার উপর গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়নি।

আলোর নামক আর একটি সম্প্রদায়ের উপর কার্ডিনার ও লিনটন জীবন চরিত, রশাক ব্যক্তিত্ব অভীক্ষা, শিশুদের অংকিত চিত্র বিশ্লেষণ প্রভৃতি বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সংগৃহীত তথ্যের মধ্যে যথেষ্ট মিল দেখতে পান। এই তথ্যের আলোকে আলোর সম্প্রদায়ের মৌলিক ব্যক্তিত্ব কাঠামোতে নিরাপত্তার অভাব, দুশ্চিন্তা, সন্দেহ প্রবণতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ও বহির্বিশ্ব সম্পর্কে আগ্রহের অভাব প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়। কার্ডিনারের মতে মায়ের অবহেলা এই মৌলিক ব্যক্তিত্বকাঠামো বিকাশের অন্যতম কারণ। আলোর শিশুকে মা তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং ভাই-বোনের কাছে রেখে দিনের বেশির ভাগ সময় ক্ষেতে কাজ করেন। মায়ের এই সান্নিধ্যহীনতার কারণে শিশুর ব্যক্তিত্বে ঐসব সংলক্ষণ বিকাশ লাভ করে বলে তিনি দাবি করেন।

কার্ডিনারের এই ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে বহু গবেষণার সূত্রপাত করেছে। উদাহরণস্বরূপ এরিক ফ্রম ও ক্যারেন হর্নির রচনাবলীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ফ্রম-এর মতে 'সামাজিক চরিত্র' গড়ে ওঠে একটি সমাজের ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনোবৈজ্ঞানিক উপাদান থেকে। ফ্রম-এর মতো হর্নিও মনে করেন যে মৌলিক ব্যক্তিত্ব বিকাশের মূলে রয়েছে একটি কৃষ্টির অন্তর্গত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য-কেবলমাত্র পরিবারের শিশু প্রতিপালন ধারা নয়। বর্তমানে 'প্রকারগত ব্যক্তিত্ব' কথাটি মৌলিক ব্যক্তিত্ব কাঠামো অপেক্ষা অধিক প্রচলিত। প্রকারগত ব্যক্তিত্ব বলতে খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলা, ধূমপান করা ইত্যাদি কার্যাবলী থেকে শুরু করে জীবন সম্বন্ধে ধারণা পর্যন্ত সামাজিক জীবন থেকে উদ্ভূত সকল বৈশিষ্ট্য যা কোন কৃষ্টির সকল সদস্যের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে প্রযোজ্য তাকেই বুঝায়। মৌলিক ব্যক্তিত্ব বা প্রকারগত ব্যক্তিত্ব যে নামেই এই ধারণাটিকে অভিহিত করা হোক না কেন, গবেষণার এই ধারাটি বর্তমানে জাতীয় চরিত্র বিষয়ক গবেষণায় রূপলাভ করেছে। জার্মান, রুশ, আমেরিকান ও জাপানীদের উপর এ ধরনের বহু গবেষণা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর আলোকপাত করেছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url