সিজোফ্রেনিয়ার কারণসমূহ

সিজোফ্রেনিয়া হলো মানসিক রোগের একটি গুরুতর ধরন। সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্ত ব্যক্তির চিন্তা, প্রত্যক্ষন এবং আবেগের চরম অবনতি ঘটে। সে সামাজিক আন্তঃক্রিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে এবং মাঝে মাঝে উদ্ভট আচরণ করে।

সিজোফ্রেনিয়ার কারণসমূহ

সিজোফ্রেনিয়ার কারণ সম্পর্কে গবেষকবৃন্দ নানা রকম ব্যখ্যা দিয়েছেন। অনেকে মতবাদের আলোকে ব্যখ্যা করেছেন আবার অনেকেই সরাসরি সিজোফ্রেনিয়ার সাথে জড়িত উপাদানগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। সিজোফ্রেনিয়ার কারণগুলো তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- জৈবিক কারণ, মনোবৈজ্ঞানিক কারণ, সমাজ-সংস্কৃতিমূলক কারণ। 

১। জৈবিক কারণঃ 

বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, সিজোফ্রেনিয়া রোগের ক্ষেত্রে বংশগতি এবং মস্তিষ্কের কার্যাবলিয়র তারতম্য গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। জৈবিক কারণের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য উপাদানগুলো হলো - জিনগত কারণ, জৈব রাসায়নিক অস্বাভাবিকতা, অস্বাভাবিক মস্তিষ্ক কাঠামো, ভাইরাসঘটিত সমস্যা। 

জিনগত কারণঃ 

জিনের ক্রুটির ফলে সিজোফ্রেনিয়া বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। সিজোফ্রেনিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট জিন নিয়ে জন্মগ্রহণকারী সন্তানেরা তরুণ বয়সের শেষের দিকে বা প্রাক-প্রাপ্ত বয়সে অতিরিক্ত মানসিক চাপের সম্মুখীন হলে তাদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া তৈরি হয়। নিকট আত্মীয়ের কারো মাঝে সিজোফ্রেনিয়া থাকলে ব্যক্তির মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া বিকাশের সম্ভাবনা অনেক বেশি। পিতামাতা দুইজনেই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হলে সন্তানদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার ঝুঁকি ৪৮% এবং পিতামাতার মধ্যে যেকোনো একজন সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্ত হলে সন্তানদের সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ১৩ ভাগ।

জৈব রাসায়নিক অস্বাভাবিকতাঃ 

মেজাজ বৈকল্যের মত সিজোফ্রেনিয়াও মস্তিষ্কের এক বা একাধিক নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যক্রমের পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কে ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যাবলি বেড়ে গেলে সিজোফ্রেনিয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ডোপামিন ক্যামিক্যাল কম তৈরি হওয়ার ঔষধ প্রয়োগের ফলে সিজোফ্রেনিয়া রোগীর লক্ষণের মাত্রা সন্তোষজনকভাবে কম হয়। অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, গ্লুটামেট নামে নিউরোট্রান্সমিটার সিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে দায়ী। এমফিটামিন জাতীয় মাদক গ্রহণ করলে এমফিটামিন সাইকোসিস দেখা দেয়, যা সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণের সাথে হুবহু মিল। এমফিটাসিন ড্রাগস মস্তিষ্কে ডোপাসিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অতএব বলা যায়, ডোপামিন নিউরোক্যমিক্যাল সিজোফ্রেনিয়ার জন্য দায়ী। 

অস্বাভাবিক মস্তিষ্ক কাঠামোঃ 

মস্তিষ্কের গঠনগত ক্রুটির সাথে সিজোফ্রেনিয়ার সম্পর্ক রয়েছে। সিজোফ্রেনিক রোগী যে ধরনের উদ্ভট আচরণ করে তার কারণ হল, গুরুত্বপূর্ন নয় এমন উদ্দীপকসমূহকে তাড়া বাছাই করতে পারে না। মনোযোগের অসুবিধা এবং তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে না পারার কারণ হলো মস্তিষ্কে সমস্যা। সিজোফ্রেনিক রোগীদের মস্তিষ্কের থ্যালামাস অপেক্ষাকৃত ছোট হয়, ভেন্ট্রিকেলস বড়, মস্তিষ্কে গর্ত দেখা দেয়, সেই গর্তে স্পাইনাল ফ্লুয়েড থাকে এবং বিপাকক্রিয়া কম হয়। 

ভাইরাসঘটিত সমস্যাঃ 

মস্তিষ্কে ভাইরাস সংক্রমণের ফলে নিউরোট্রান্সমিটার এবং কাঠামোগত অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, শিশু জন্মের আগে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলে তা বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত সুপ্ত থাকে এবং ভিতরে ভিতরে মস্তিষ্কে ক্ষতি সাধন করে। উক্ত ভাইরাস তরুণ বয়সে হরমোনের দ্বারা আবারও উদ্দীপিত হয় এবং সিজোফ্রেনিয়ার বিকাশ ঘটায়। 

২। মনোবৈজ্ঞানিক কারণঃ 

মনোবৈজ্ঞানিক কারণ হিসেবে মনোবিজ্ঞানের মতবাদ বা দৃষ্টি ভঙ্গিগুলোকে বিবেচনা করা হয়। যথা - মনঃসমীক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণগত দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানমূলক মতবাদ। 

মনঃসমীক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গিঃ 

শিশু বয়সের প্রচণ্ড মানসিক চাপ বা ট্রমাটিক স্মৃতি পরবর্তী জীবনে সিজোফ্রেনিয়া রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। মনঃসমীক্ষণবাদীরা মনে করেন, ব্যক্তি মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ইত্যাদির সম্মুখীন হলে ছোটবেলার ট্রমাটিক স্মৃতির কথা মনে পড়ে, এতে করে সে আরও বিপর্যস্ত হয়। গবেষকরা বলেন, যে সকল পিতামাতা তাদের শিশুদেরকে স্নেহ ভালোবাসা প্রদান না করে কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ এবং প্রত্যখ্যান করেন সে সকল শিশুদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় পিতামাতারা সন্তানদেরকে পরস্পর বিরোধী নিয়ম কানুন শেখায়, ফলে সন্তানেরা একটি দান্দ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। এর ফলে শিশুরা পরবর্তী সময় সিজোফ্রেনিয়ার সম্মুখীন হয়।

আচরণগত দৃষ্টিভঙ্গিঃ 

স্কিনারের করন শিক্ষণের বলবর্ধক (Reinforcement) মূলনীতিটি সিজোফ্রেনিয়া ব্যখ্যার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। বলবর্ধক নীতি অনুযায়ী, মানুষ ভাল কাজের স্বীকৃতি খোঁজে এবং অন্যের সমর্থন চায়। সামাজিক কার্যকলাপে সমর্থন বা পুরস্কার পেলে মানুষের আত্ম ধারণা ইতিবাচক হয়। সমর্থন বা পুরস্কার না পেলে মানুষ নিজেকে পরিবার বা সমাজ থেকে গুটিয়ে নেয় এবং কিছু অযৌক্তিক বা অবাস্তব উদ্দীপকের প্রতি মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। যেমন, কোনো কক্ষের উজ্জ্বল আলোর প্রতি মনোযোগ দেয়, আকাশে পাখি উড়লে পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে, কোনো অর্থহীন শব্দ শুনে, ইত্যাদি। সামাজিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে না পেরে এ সকল উদ্ভট কার্যকলাপের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়। ধীর্ঘদিন ধরে অবাস্থব উদ্দীপকের প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়ার ফলে ব্যক্তি উদ্ভট আচরণ করে। পরবর্তি সময়ে উদ্ভট আচরণগুলো পুরস্কৃত হওয়ার ফলে তার মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ বেড়ে যায়। 

জ্ঞানমূলক মতবাদঃ 

কোনো ব্যক্তি যখন পরিবেশের সকল উদ্দীপকের প্রতি অতিমাত্রায় মনোযোগ দিতে যায় তখন সে বেশি মাত্রায় বিচলিত হয়ে যায়। সবগুলো উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়া করতে গিয়ে জ্ঞানমূলক উপাদানের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে সে তথ্য প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যর্থ হয়। আবার কম মনোযোগী হলেও তাদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া বিকশিত হয়। সিজোফ্রেনিয়া রোগীরা পরিবেশের গুরুত্বপূর্ন উপাদানের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ন উপাদানের উপর বেশি জোর দিতে গিয়ে সে অতিমাত্রায় আবেগীয় অবস্থায় পড়ে। 

৩। সমাজ সংস্কৃতিমূলক উপাদান 

সিজোফ্রেনিয়া রোগ বিস্তার লাভের ক্ষেত্রে সামাজিক এবং বহুমুখী সংস্কৃতিমূলক উপাদানের ভূমিকা রয়েছে।

বহুবিধ সংস্কৃতিমূলক উপাদানঃ 

একটি দেশে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষ বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ভিন্ন থাকে। সংস্কৃতির পার্থক্যের কারণে সিজোফ্রেনিয়া রোগ দেখা দেয়। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপরও সিজোফ্রেনিয়া রোগীর সংখ্যা নির্ভর করে। অর্থনৈতিক দিকে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া বেশি দেখা দেয়। 

সামাজিক পরিচিতিকরণ (Socail Labeling): 

অনেক সময় দেখা যায় কিছু মানুষ সৌজন্যমূলক সামাজিক আচরণ করতে ব্যার্থ হয়। তখন অন্য লোকেরা তাদের পাগল বলে আখ্যায়িত করে। পরবর্তিতে অন্যরা সবাই তাদের মানসিক রোগী হিসেবে বিশ্বাস করে এবং তাদেরকে অকারণে বিরক্ত করতে থাকে। যার ফলে, তাদের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, বরং তাদের মধ্যে সাইকোটিক সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায়।

পারিবারিক উপাদানঃ 

অনেক সময় পারিবারিক আন্তঃক্রিয়া থেকে সিজোফ্রেনিয়া তৈরি হয়। পারিবারিক মানসিক চাপের সাথে সিজোফ্রেনিয়ার সম্পর্ক রয়েছে। পরিবারের সদস্যদের পরস্পরবিরোধী আচরণ সন্তানদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া তৈরি হয়। পরিবারের সদ্যস্যরা যদি এক অপরের প্রতি ধ্বংসাত্মক, অপমানজনিত, অসমর্থনমূলক এবং সমালোচনামূলক আচরণ করে তবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। যে সকল পরিবারের সদস্যরা উচ্চমাত্রায় নেতিবাচক আবেগ প্রকাশ করে তাদের পরিবারের যেকোনো সদস্য সিজোফ্রেনিয়া রোগী হিসেবে হাসপাতাল থেকে ভাল হয়ে আসলেও পুনরায় তাদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, কোনো ব্যক্তির সিজোফ্রেনিয়া রোগ সৃষ্টির পেছনে বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে জৈবিক, মনোবৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-সংস্কৃতিমূলক কারণসমূহ উল্লেখযোগ্য।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url