প্রভুগ্রন্থি : পিটুইটারী গ্রন্থির গঠন ও কার্যাবলী

গ্রন্থি এক প্রকার জৈবিক অঙ্গ। আমাদের দেহে কতকগুলো রস ক্ষরণকারী গ্রন্থি রয়েছে। এ গ্রন্থিগুলো স্বনালি ও অনালি গ্রন্থি এ দুই ভাগে বিভক্ত। অনালি গ্রন্থিসমূহের মধ্যে পিটুইটারি গ্রন্থি অন্যতম।

যে কারণে পিটুইটারী গ্রন্থিকে প্রভু গ্রন্থি বলা হয়: 

অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলো মধ্যে পিটুইটারি গ্রন্থি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য। এ গ্রন্থির অবস্থান মস্তিষ্কের মাঝখানে এবং হাইপোথ্যালামাসের নিচে। এ গ্রন্থি অনেকটা মটর দানার মতো। এর তিনটি অংশ রয়েছে। যথা: সম্মুখ ভাগ, মধ্য ভাগ এবং পশ্চাৎ ভাগ।

এ তিনটি অংশ থেকেই মানবদেহে বেশ কতকগুলো হরমোন নিঃসৃত হয় এবং হরমোনগুলো প্রাণীর দেহমনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। সম্মুখ অংশ থেকে ৬ ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। মধ্য ভাগ থেকে এ এবং বি মেরানোসাইট উদ্দীপক হরমোন বেব হয়ে ত্বকের পিগমেন্টেশন সৃষ্টি করে। পশ্চাৎ ভাগ থেকে পশ্চাৎ ভাগ হতে নিঃসৃত হরমোন হলো এন্ট্রি ডিউরেটিক হরমোন ও অক্সিটোসিন হরমোন।

পিটুইটারি গ্রন্থি তার নিজস্ব কার্যাবলি ছাড়াও এড্রিনাল, থাইরয়েড ও যৌন গ্রন্থির ক্রিয়াকেও কিছু মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এ গ্রন্থিকে 'Master Gland' বা প্রভুগ্রন্থি বলা হয়। পিটুইটারি গ্রন্থির হরমোন প্রাণীদেহের গঠন বিন্যাস ও আচরণকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। এছাড়া দেহের অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থির ক্ষরণক্রিয়াও এ গ্রন্থির হরমোনের প্রভাবের ওপর নির্ভর করে। তাই একে অন্তঃক্ষরা সুইচবোর্ডও বলা হয়।

পিটুইটারী গ্রন্থির গঠন ও কার্যাবলী:

যেসব গ্রন্থি নালিবিহীন, এবং যাদের ক্ষরণ রক্ত বা লাসিকার মাধ্যমে বাহিত হয়ে দূরবর্তী সুনির্দিষ্ট অঙ্গে ক্রিয়াশীল হয়; সেসব গ্রন্থিকে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি বলে। একে অনালগ্রন্থি (ductless gland)-ও বলা হয়। মানবদেহের অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোর প্রধান হলো পিটুইটারী গ্রন্থি। অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোর মধ্যে পিটুইটারি গ্রন্থির ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

পিটুইটারি গ্রন্থি: 

এই গ্রন্থির অবস্থান মস্তিষ্কের কেন্দ্রস্থলে এবং হাইপোথ্যালামাসের ঠিক নিচে। এটা দেখতে আকারে ডিমের মতো এবং আয়তনে একটা মটর দানার মতো। এ গ্রন্থি নিজস্ব কাজ ছাড়াও এড্রিনাল, থাইরয়েড ও যৌন গ্রন্থির কাজকেও কিছু মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো বিশেষ কারণে এড্রিনাল, থাইরয়েড এবং যৌনগ্রন্থির যে কোনো একটির ক্ষরণ হ্রাস পেলে পিটইটারি একটি উপযুক্ত হরমোন তৈরি করে পরিস্থিতিকে একটি স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসে। তাই পিটুইটারি গ্রন্থিকে 'প্রভু গ্রন্থি' বলা হয়। পিটুইটারি গ্রন্থির ৩টি অংশ আছে। যথা: (ক) সম্মুখ ভাগ (খ) মধ্য ভাগ এবং (গ) পশ্চাৎ ভাগ।

ক. সম্মুখ ভাগ: পিটুইটারি গ্রন্থির সম্মুখ ভাগ থেকে ৬ ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। যথাঃ

১. শরীরবর্ধক হরমোন: এ হরমোন শারীরিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ হরমোন প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্ষরিত হলে শরীরের অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটে এবং একজন অল্প বয়স্ক কিশোরও ৬ থেকে ৮ ফুট লম্বা হতে পারে। আবার এ হরমোনের ক্ষরণ কম হলে মানুষ খর্বাকৃতির হয়ে থাকে।

২. থাইরোট্রোপিন: এ হরমোন থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষরণকে উদ্দীপিত করে।

৩. এড্রিনোকোর্টিকোট্রোপিন: এ হরমোন এড্রিনাল গ্রন্থির ক্ষরণ এবং এর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 

৪. ফলিকল উদ্দীপক হরমোন: এটি স্ত্রী ডিম্বাশয়ের ফলিকল গঠন ও পুরুষ জনন কোষের পূর্ণতা লাভে সহায়তা করে। এর অভাবে ডিম্বাশয়ের ডিম্বথলি পরিপক্ক হতে পারে না বলে ডিম্বস্খলন ও গর্ভধারণ প্রক্রিয়ায় গোলযোগ দেখা দেয়। 

৫. লিউটিনাইজিং হরমোন: এ হরমোনের প্রভাব স্ত্রীদেহে ডিম্বথলি, পরিপক্বতা, ডিম্বাশয়, ঋতুস্রাব অনুপ্রাণিত হয়। পক্ষান্তরে এর প্রভাবে পুরুষদেহে শুক্রাশয়ের লেডিগ কোষমালা তৎপর হলে টেস্টেস্টেরন নিঃসৃত হয়।

৬. প্রোলেকটিন: এ হরমোন ক্ষরণের ফলে গর্ভবর্তী মায়েদের স্তনে দুধের সঞ্চার হয় এবং মাতৃসুলভ আচরণ প্রকাশ পায়। শরীরের বৃদ্ধি যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন যদি সম্মুখ অংশ থেকে অতিরিক্ত রস ক্ষরণ হয়, তা হলে 'Acromegaly' নামক এক ধরনের রোগ হয়, যার ফলে হাত, পা, মুখমণ্ডল বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দেহের আকৃতি তুলনামূলকভাবে স্থূল হয়। তবে সম্মুখ স্ফীতির ফলে Simmond's disease দেখা দিতে পারে। ফলে যৌনক্রিয়া হ্রাস পায়।

খ. মধ্য ভাগ: পিটুইটারি গ্রন্থির মধ্যভাগ থেকে 'এ এবং বি মেরানোসাইট উদ্দীপক হরমোন (A & B, MSH)' নিঃসৃত হয়। মেলানোফোর এর বিস্তৃতি সাধন করে। এটি ত্বকের পিগমেন্টেশনের জন্যে দায়ী।

গ. পশ্চাৎ ভাগ: পিটুইটারি গ্রন্থির পশ্চাৎ ভাগ হতে নিঃসৃত হরমোন হলো:

১. এন্ট্রি ডিউরেটিক হরমোন: এর হরমোনের প্রধান প্রধান কাজসমূহ হলো:

  • এই হরমোনের প্রভাবে ধমনি প্রাীর সঙ্কুচিত হয়, ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়।
  • অধিক পরিমাণে মূত্র নির্গমন প্রতিরোধ করা এ হরমোনের মূল কাজ। এ হরমোনের অভাবজনিত কারণে ডায়াবেটিকস ইনসুপিডাস রোগ দেখা দেয়।
  • মূত্রাধিক্য রোধে কিডনির ওপর প্রভাব বিস্তার করে এটি মূত্রের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। 

২. অক্সিটোসিন হরমোন: এর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হলো:

  • এ হরমোনটি প্রধানত জরায়ুর পেশির সংকোচন ঘটিয়ে প্রসবের সূচনা করে ও সন্তান নির্গমনের সহায়তা করে।
  • এটি দুগ্ধবতী মাতার স্তন হতে দুগ্ধ নিঃসরণে সাহায্য করে থাকে।
  • এটি যৌন ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে থাকে।

পিটুইটারি গ্রন্থির ব্যাপক কার্যকলাপের জন্যে একে অন্তঃক্ষরা সুইচ বোর্ড নামেও অভিহিত করা হয়।

উপসংহার: পিটুইটারি গ্রন্থি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থি। এ গ্রন্থির পশ্চাৎ অংশ সম্মুখ অংশ থেকে কম সক্রিয়। পিটুইটারি গ্রন্থির ব্যাপক কার্যকলাপের জন্যে একে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির সুইচ বোর্ড বলা হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url