মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষণ পদ্ধতির পদক্ষেপসমূহ

 মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষণ পদ্ধতির পদক্ষেপসমূহ (Steps in Experimental Methods)

যে কোন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে গবেষণা পরিচালনা করতে হলে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি স্তর অতিক্রম করতে হয়। মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষণ পদ্ধতিতে এই স্তরগুলি অনুসরণ করা হয়। এর ফলে প্রাপ্ত ফলাফল বস্তুনিষ্ঠ হয়ে থাকে। স্তরগুলি নিবরূপ : 

১. সমস্যা স্থিরীকরণ (Identification of the problem) 

২. অনুমান বা প্রকল্প প্রণয়ন (Framing of hypothesis)

৩. প্রত্যয় বা ধারণা গঠন (Concept formation) 

৪. চল সনাক্তকরণ (Identification of variables)

৫. পরীক্ষণ ও যন্ত্রপাতি পরিকল্পনা (Designing of experiment and apparatus) 

৬. উপাত্ত সংগ্রহ ও তার ব্যাখ্যা (Collection of data and their interpretation) 

৭. সাধারণ নিয়ম প্রণয়ন (Generalization)

৮. যথার্থ প্রতিবেদন (Verification)

(১) সমস্যা স্থিরীকরণ : যে কোন ধরনের পরীক্ষণ পরিচালনা করতে হলে প্রথমে একটি সমস্যা ঠিক করে নিতে হয়। সমস্যাটি স্থির করার পর এর ওপরেই পরীক্ষণ পরিচালনা করা হয়। সুতরাং সমস্যার প্রকৃতি সম্পর্কে পরীক্ষণকারীর সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে পরীক্ষকের পক্ষে পরীক্ষণ পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ে।

গবেষকদের মতে সাধারণত তিনটি উপায়ে সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় : ১. বাস্তব অবস্থার পর্যবেক্ষণ; ২. অতীত গবেষণা অধ্যয়ন এবং ৩. সমস্যা সম্পর্কে পরীক্ষণকারীর নিজস্ব জ্ঞানের পরিধি। বর্তমানে মনোবিজ্ঞানের গবেষণা এবং পরীক্ষণসমূহ প্রায়ই বাস্তবধর্মী সমস্যা নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। প্রথমত, একজন সূক্ষ্মদর্শী মনোবিজ্ঞানী মানুষের আচরণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমস্যা স্থির করতে পারেন। সুতরাং বাস্তব ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করেই তিনি সমস্যা খুঁজে বের করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, অতীতের গবেষণাকার্য সব সমস্যার যে সমাধান দিতে পেরেছে এমন নয়। এসব সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিতেও অনেক নতুন সমস্যা ও নতুন গবেষণার বিষয়বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত থাকে। সুতরাং পূর্বে সম্পাদিত গবেষণা অধ্যয়নের মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানীরা অনেক নতুন সমস্যার সন্ধান পেয়ে থাকেন। তৃতীয়ত, এমন অনেক সূক্ষ্মদর্শী গবেষক আছেন যাঁরা নিজস্ব জ্ঞান ও চিন্তাশক্তির বলে অনেক নতুন সমস্যা নির্দেশ করতে পারেন। আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কার এভাবেই সম্ভব হয়েছে।

(২) অনুমান বা প্রকল্প প্রণয়ন : পূর্বেই বলা হয়েছে পরীক্ষণের ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা অর্থাৎ সমস্যা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের পর পরীক্ষক এর সমাধানের জন্য কতকগুলি পন্থার কথা চিন্তা করেন। কি পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করা যায় এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাসও প্রকল্পের অধীন। অর্থাৎ কোন অবস্থাতে পরীক্ষণ পাত্রের ওপর একটি স্বাধীন চলের কিরূপ পরিবর্তন ঘটালে তার মধ্যে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে পরীক্ষক তা আগেই অনুমান করে নেন। প্রকল্পের মাধ্যমেই অনুসন্ধানের কাজকে সীমিত রাখা হয় অর্থাৎ পরীক্ষণকার্য একটি সুনির্দিষ্ট পন্থায় পরিচালিত হয়। প্রকল্প কর্তৃক নির্ধারিত পথে অনুসন্ধান করার পর যদি সমস্যার যথার্থ সমাধান হয় তাহলে বলা যায় যে প্রকল্পটি সমর্থিত হল। আর যদি সঠিক সমাধান না হয় তাহলে প্রকল্পটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

(৩) প্রত্যয় বা ধারণা গঠন : প্রত্যয় গঠন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কোন সমস্যার সমাধানকল্পে বিজ্ঞানীরা যেসব শব্দ বা পদ ব্যবহার করেন তার অন্তর্নিহিত অর্থ বিভিন্ন বিজ্ঞানীর কাছে বিভিন্ন রকম হতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এসব পদের অর্থ সকল বিজ্ঞানীর কাছে একইরূপ হতে হবে। তাহলে যে কোন বিজ্ঞানী অনুরূপ সমস্যার সমাধানে ঐ পদকে একই অর্থে ব্যবহার করতে পারেন। যেমন যদি প্রকল্প নেয়া হয় যে, 'প্ররোচক' (incentive) দিলে কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। তাহলে ‘প্ররোচক' ও 'কর্মদক্ষতা' এই দুটি শব্দ কি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে সে সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। প্ররোচক বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন মৌখিক উৎসাহ, বোনাস বা অতিরিক্ত অর্থপ্রদান, পদোন্নতি, ছেলেমেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা, চিকিৎসার সুবিধাদি, বাসস্থান ইত্যাদি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই প্রকল্পটির যথার্থতা যাচাই করার সময় কি ধরনের প্ররোচকের কথা বলা হয়েছে তার উল্লেখ করতে হবে। তেমনিভাবে কর্মদক্ষতা বলতে অধিক উৎপাদন, দায়িত্ববোধ, অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা সব কিছুই বোঝায় অথবা এর যে কোন একটিও হতে পারে। বিজ্ঞানী তাঁর অনুসন্ধান কর্মদক্ষতা বলতে যা বুঝাতে চেয়েছেন তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে। অনুমান স্থিরীকরণের পর এভাবে অনুমানে উল্লিখিত ধারাণাগুলির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পরীক্ষণ পদ্ধতির একটা অপরিহার্য অঙ্গ। এটাকে ব্যবহৃত প্রত্যয়ের প্রায়োগিক সংজ্ঞা বলা হয়।

(৪) চল সনাক্তকরণ : অনুমান স্থির করার পর এতে যেসব শব্দ বা পদকে কারণ ও ফলাফল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তা পৃথক করতে হবে। কারণ হিসেবে যে পদকে উল্লেখ করা হয়েছে তা হবে অনির্ভরশীল চল আর ফলাফল হবে নির্ভরশীল বা অপেক্ষী চল। পরীক্ষণকারী স্বাধীন চলকে পরিবর্তন করে পরীক্ষণ পাত্রের ওপর প্রয়োগ করেন। এই পরিবর্তনের দরুন পরীক্ষণ পাত্রের যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তাই হল নির্ভরশীল চল। স্বাধীন চলের ওপর নির্ভরশীল বলেই একে নির্ভরশীল চল বলা হয়। নিরপেক্ষ ও নির্ভরশীল চল ছাড়া পরীক্ষণ পদ্ধতিতে আরও কতকগুলি চলের উল্লেখ থাকে। এগুলি বাহ্যিকভাবে দেখা যায় না বটে তবে ভিতরে ভিতরে স্বাধীন ও নির্ভরশীল চলের মধ্যে একটা সংযোগ রক্ষা করে। পরীক্ষক এগুলিকে সবসময় অপরিবর্তিত রাখেন। এগুলিকে অপরিবর্তিত রেখে নিয়ন্ত্রণ না করলে এগুলি নির্ভরশীল চলকে প্রভাবিত করতে পারে। এগুলিকে বলা হয় অন্তর্বর্তী চল (intervening variables)। পরীক্ষণ পাত্রের বয়স, শিক্ষা, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, প্রেষণা, মনোভাব ইত্যাদি এই জাতীয় চলের অন্তর্ভুক্ত।

(৫) পরীক্ষণ ও যন্ত্রপাতি পরিকল্পনা : সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষণ পরিচালনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপরেখাকেই বলা হয় পরীক্ষণের পরিকল্পনা। একটি নকশার আকারে লেখা হয় বলেই একে পরীক্ষণ নকশাও বলা হয়। একটি পরীক্ষণ কিভাবে পরিচালনা করা হয়েছে একজন মনোবিজ্ঞানী তার সমগ্র কার্যপ্রক্রিয়াটি না পড়েও শুধুমাত্র নকশাটি দেখে বুঝতে পারেন পরীক্ষণটি কিভাবে পরিচালনা করা হয়েছে। সুতরাং অনুরূপ সমস্যা সমাধানে বা এর যথার্থ প্রতিপাদনে অন্য যে কোন মনোবিজ্ঞানী এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সমস্যাটিকে পুনঃপ্রমাণ করে দেখতে পারেন।

বর্তমানে মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের জটিল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। এগুলির পরিকল্পনা যথার্থ না হলে গবেষণা কাজে অনেক অসুবিধা দেখা দিতে পারে ও ভুল ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। কেননা পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ব্যাখ্যা অনেকাংশে এসব যন্ত্রপাতির ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে। বিশেষ করে প্রাণীর গবেষণায় ম্যান যন্ত্রপাতি পরিকল্পনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে মনে করেন যন্ত্রপাতি পরিকল্পনার পার্থক্যের কারণেই শিক্ষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। যেমন মনোবিজ্ঞানী লয়েড মারগ্যান ও থর্নডাইকের মতে প্রাণী বিশেষ শুধুমাত্র প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে। পক্ষান্তরে হবহাউস, ডাংকার, কোজ প্রমুখ মনোবিজ্ঞানী অনুরূপ প্রাণী নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন যে প্রাণীবিশেষ অন্তর্দৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষালাভ করতে সক্ষম। থর্নডাইকের ধাঁধা বাক্স, স্কিনারের জটিল বাক্স ইত্যাদি যন্ত্রপাতির পরিকল্পনা এরূপ ছিল যে প্রাণীবিশেষ সমগ্র সমস্যাটিকে একবারে একই সাথে অবলোকন করতে পারেনি। ফলে সে বুদ্ধি প্রয়োগে সমাধানের পথ খুঁজে পায়নি। এসব পরিস্থিতির সাথে প্রাণী একদিকে যেমন অভ্যস্ত ছিল না অন্যদিকে তেমনি খাদ্যবস্তুও ছিল তাদের দৃষ্টির আড়ালে। এজন্য প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধনের মাধ্যমে ছাড়া সমস্যা সমাধানের অন্য কোন উপায় ছিল না (Ali, M. R., 1983)।

অন্যদিকে কোহলার, টলম্যান প্রমুখ মনোবিজ্ঞানী যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন সেগুলির নকশা এমনভাবে তৈরি ছিল যে প্রাণীবিশেষ সমস্যার সমগ্র রূপটি একেবারে অবলোকন করতে সক্ষম হয়। ফলে সেখানে তারা বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারে।

(৬) উপাত্ত সংগ্রহ ও তার ব্যাখ্যা : উপাত্ত সংগ্রহ ও তার ব্যাখ্যা দেয়া পরীক্ষণ পদ্ধতির একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী পরীক্ষণ পরিচালনা করার সময় উপাত্ত সংগ্রহে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। উপাত্ত সংগ্রহে কোনরূপ ভুল-ভ্রান্তি হলে তার ওপর নির্ভর করে কোন যথার্থ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। আজকাল শরীরাভ্যন্তরের ক্রিয়াকলাপ লিপিবদ্ধ করার জন্য নানা ধরনের জটিল বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যেমন ইলেকট্রো ইনসেফালোগ্রাফ, সাইকোগ্যাল-ভ্যানোমিটার, পলিগ্রাফ, নিউমোগ্রাফ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এইসব যন্ত্র ব্যবহারের সময় খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কেননা এসব যন্ত্রপাতির মাধ্যমে শরীরাভ্যন্তরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলি লিপিবদ্ধ করার সময় শরীরের সামান্য নড়াচড়ার কারণে অথবা অন্যান্য কারণেও প্রাপ্ত তথ্য ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে।

উপাত্ত সংগ্রহের পর তার সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। এলোমেলো উপাত্তের স্তূপ থেকে কোন অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। উপাত্তের যথার্থ অর্থ খুঁজে পাবার জন্য বিভিন্ন পরিসংখ্যান পদ্ধতির সাহায্য নেয়া হয়। পরিসংখ্যান পদ্ধতিতে বিশ্লেষণের পর প্রাপ্ত ব্যাখ্যাই অর্থপূর্ণ হয়। তাই উপাত্ত সংগ্রহের পর সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য পরিসংখ্যানের প্রয়োজনীয় পদ্ধতিতে তার ব্যাখ্যাদান পরীক্ষণ পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। 

(৭) সাধারণ নিয়ম প্রণয়ন : বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করা। পরিসংখ্যান পদ্ধতিতে উপাত্তের বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার একটি অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রাপ্ত তথ্যের সাথে প্রকল্পে উল্লেখিত প্রত্যাশিত তথ্যের মিল আছে কি-না তা যাচাই করা হয়। যদি প্রাপ্ত তথ্য প্রত্যাশিত তথ্যের অনুরূপ হয় তাহলে পরীক্ষক তাঁর প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে একটি সাধারণ নিয়ম তৈরি করতে পারেন। এই নিয়মের আওতায় তিনি প্রাপ্ত তথ্যকে মাত্র একজন ব্যক্তি বা বস্তুর ওপর প্রয়োগ না করে ঐ জাতীয় সকল ব্যক্তি বা বস্তুর ওপর প্রয়োগ করতে পারেন। তবে সাধারণ নিয়ম প্রকাশের আগে তাঁকে ঐ জাতীয় আরও কতকগুলি উদাহরণ সংগ্রহ করতে হবে। যেমন পরীক্ষক যদি অনেকগুলি ছাত্রের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন যে কোন কিছু শেখার পর নিদ্রা গেলে শিক্ষালব্ধ বিষয়ের সংরক্ষণের পরিমাণ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি হয় কেবল তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে এই নিয়ম কমবেশি সকল শিক্ষার্থীর বেলায় প্রযোজ্য।

(৮) যথার্থ প্রতিপাদন বা পুনঃপ্রমাণ : বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সর্বশেষ স্তর হল পরীক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা। এজন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার-ক্ষেত্রে এই স্তরের গুরুত্ব অনেক বেশি। পরীক্ষক তাঁর প্রাপ্ত তথ্যকে সাধারণ নিয়ম হিসেবে প্রকাশ করা মাত্রই তা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আওতাভুক্ত হতে পারে না। কোন জ্ঞান বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে তার যথার্থ প্রতিপাদন দরকার। পরীক্ষক নিজে অথবা কোন গবেষক বিভিন্ন লোকের ওপর বারবার একই পদ্ধতিতে পরীক্ষণ চালিয়ে যদি একই ফল পান তবেই বলা যাবে সাধারণ নিয়মে বর্ণিত ঘোষণাটি যথার্থ হয়েছে এবং কেবলমাত্র তখনই প্রাপ্ত জ্ঞানটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং সাধারণ নিয়ম প্রকাশ করলেই তাকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বলা যায় না। এর জন্য দরকার হয় যথার্থ প্রতিপাদন। 

সুবিধা

১. পরীক্ষণ পদ্ধতির প্রধান সুবিধা নিয়ন্ত্রণ। যেহেতু গবেষণাগারের কৃত্রিম পরিবেশে পরীক্ষণ পরিচালনা করা হয় সেহেতু পরীক্ষণ চলাকালীন অবস্থায় সম্পূর্ণ পরীক্ষকের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। ফলে তিনি প্রয়োজনমতো পরিবর্তন আনতে পারেন। এই পরিবর্তন কি ধরনের হবে এবং কতটুকু হবে সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ জ্ঞাত থাকেন।

২. পরীক্ষণ পদ্ধতির আর একটি বড় রকমের সুবিধা হল পরীক্ষণের পুনরাবৃত্তি। মনোবিজ্ঞানের কোন সমস্যা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে একজন মনোবিজ্ঞানী একটা চলকে পরিবর্তন করে একটা পরিকল্পনার মাধ্যমে অন্যান্য চলগুলিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করেন যে অন্য কোন মনোবিজ্ঞানী ঐ একই সমস্যার সমাধানকল্পে অনুরূপ অবস্থা সৃষ্টি করে পরীক্ষণের প্রাপ্ত ফলাফল পুনরায় যাচাই করে দেখতে পারেন। কিংবা ঐ মনোবিজ্ঞানী নিজেই অন্য কোন সময়ে তার পুনরাবৃত্তি করতে পারেন। পরীক্ষণ নকশায় এমন একটা সুনির্দিষ্ট পন্থার উল্লেখ থাকে যাতে ফলাফল যাচাইয়ের জন্য যে কোন মুহূর্তে এর পুনরাবৃত্তি করা যায়। এতে পরীক্ষণের ফলাফল যথার্থ হল কি-না তার মূল্যায়ন করা যায়।

৩. এই পদ্ধতি সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ ফলাফল প্রদান করে। প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণে পরীক্ষক নিজের মতামত অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন না। ফলাফলের ওপর হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ থাকে না। ফলে প্রাপ্ত ফলাফল পরীক্ষকের ব্যক্তিগত প্রভাব থেকে যুক্ত থাকে। সুতরাং ফলাফল পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হতে পারে না। এ কারণেই এই পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি বস্তুনিষ্ঠতার দাবি রাখে।

৪. এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ফলাফল ব্যক্তিগত প্রভাব ছাড়াও অন্যান্য সম্ভাব্য সকল প্রকার জটিল ও অস্পষ্ট চলের প্রভাব থেকেও মুক্ত থাকে। কারণ এই পদ্ধতিতে সতর্কতার সাথে আচরণকে পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ করা হয়।

৫. এই পদ্ধতিতে একটি বিশেষ মুহূর্তে একটি মাত্র চলের পরিবর্তন ঘটিয়ে তার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা হয়। ফলে এই পদ্ধতি আচরণ সম্পর্কিত দুটি ঘটনার মধ্যে যথার্থ কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের নিশ্চয়তা দান করে।

৬. এই পদ্ধতিতে অনির্ভরশীল চলের পরিমাণগত পরিবর্তন এবং প্রাপ্ত তথ্যের সংখ্যাত্মক বিশ্লেষণ সম্ভব। নিরপেক্ষ চলের পরিমাণগত পরিবর্তনের ফলে নির্ভরশীল চলের কতটুকু পরিবর্তন সাধিত হল সংখ্যার মাধ্যমে তা প্রকাশ করা সম্ভব হয়। এই পরিমাণগত পরিবর্তন এবং তার ফলাফলকে রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো যায়। এজন্য অন্যান্য পদ্ধতি অপেক্ষা এই পদ্ধতি অধিক বিজ্ঞানসম্মত ও প্রায়োগিক। 

৭. অনির্ভরশীল ও নির্ভরশীল চলের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ে এই পদ্ধতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরীক্ষণ পাত্রের অন্তর্দৃষ্টিমূলক বিবরণ বিবেচনা করে।

এই অন্তর্দৃষ্টিমূলক বিবরণ বিবেচনার ফলে পরীক্ষণের মাধ্যমে আশানুরূপ ফল পাওয়া না গেলে তার ব্যাখ্যা দান সহজ হয়। এই কারণেই মনোবিজ্ঞানীদের কাছে এই পদ্ধতির প্রয়োজন এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁরা অনেক সময় এর অসুবিধাগুলিকে উপেক্ষা করে থাকেন।

পরীক্ষণ পদ্ধতি হল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আচরণের কার্যকারণ সম্পর্ক অনুসন্ধানে মনোবিজ্ঞান পরীক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে বলেই বিশ্বের দরবারে আজ বিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ করেছে। অন্যকথায় পরীক্ষণ পদ্ধতিই মনোবিজ্ঞানকে সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য অর্জনে সহায়তা করেছে।

অসুবিধা

পরীক্ষা পদ্ধতির এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই পদ্ধতি ত্রুটিমুক্ত নয়। যদিও এর অসুবিধাগুলি মনোবিজ্ঞানীরা সাধারণত উপেক্ষা করেন তথাপি এগুলি সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে পরীক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্ত মূল্যায়নে বিশেষ সুবিধা হয়। এই পদ্ধতির ত্রুটিগুলি নিবরূপ :

প্রথমত, এই পদ্ধতির প্রয়োগ ক্ষেত্র সীমিত। এতে গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট অবস্থার মধ্যে আচরণ পরীক্ষা করতে হয়। আচরণ পর্যবেক্ষণের জন্য অনেক সময় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় না। কারণ মানুষ বা প্রাণী জড় পদার্থ নয় যে প্রয়োজন হলেই তাদেরকে গবেষণাগারে কৃত্রিম অবস্থার মধ্যে এনে পরীক্ষণ পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নশাস্ত্রে ব্যবহৃত জড় পদার্থগুলি স্বাভাবিক অবস্থায় অপরিবর্তনীয় থাকে। এবং এমন সহজে নাড়াচাড়া করা যায় যে, তাদের সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। ফলে এসব শাস্ত্রে পরীক্ষণ থেকে যে ফলাফল পাওয়া যায় তা নির্ভুল হয়। কিন্তু মনোবিজ্ঞানে মানুষ বা প্রাণীর যেসব আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয় সেগুলি সকল মানুষ বা প্রাণীর ক্ষেত্রে একই রকম হয় না। এগুলি একই মুহূর্তে বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কিংবা একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন মুহূর্তে বিভিন্ন রকম হতে পারে। এজন্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ন্যায় মনোবিজ্ঞানে পরীক্ষণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নির্ভুল, অতি সুনির্দিষ্ট, অতিসূক্ষ্ম অথবা যথার্থ ফলাফল পাওয়া যায় না। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আচরণগত পার্থক্য থাকার দরুণ একজন ব্যক্তির ওপর পরীক্ষণ পরিচালনা করে কোন আচরণ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। এজন্য বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর একই ধরনের উদ্দীপক প্রয়োগ করে তার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, পূর্বেই বলা হয়েছে এই পদ্ধতি গবেষণাগারে কৃত্রিম অবস্থার সৃষ্টি করে। মনোবিজ্ঞানীকে কোন মানুষের আচরণ অনুসন্ধান করতে হলে তাকে গোয়েন্দার মতো অথবা সন্দেহের মধ্যে কাজ করতে হয়। মনুষ্য আচরণ অনুধ্যানে গবেষণাগারের মধ্যে সব সময় একই ধরনের কৃত্রিম অবস্থা সৃষ্টি করা যায় না। অথচ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের গবেষণাগারের কৃত্রিম অবস্থার মধ্যে প্রাপ্ত ফলাফল বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে প্রাপ্ত ফলাফলের অনুরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মাঝে মাঝে গবেষণাগারের প্রাপ্ত ফলাফল প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে প্রাপ্ত ফলাফল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা অথবা অর্থহীন হয়ে থাকে। অবশ্য মনোবিজ্ঞানীরা আচরণ অনুধ্যানে সব সময় সাবধানতা অবলম্বন করেন যাতে পরীক্ষণলব্ধ ফলাফল নির্ভরযোগ্য হয়।

তৃতীয়ত, এই পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার আর একটি কারণ হল অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু। যে সমস্যা নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয় সেই সমস্যাই অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি করে। যেমন ধরা যাক কর্ম পরিবেশের গোলমাল অথবা ক্লান্তি উৎপাদনের ওপর কিরূপ প্রভাব বিস্তার করে তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যেসব কর্মীকে পরীক্ষণ পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে তারা যদি পরীক্ষককে সাহায্য করবার জন্য অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়ে কাজ করে তাহলে পরীক্ষক হয়তো তীব্র গোলমালের মধ্যেও ক্লান্তির কোন চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাবেন না। ফলে প্রকৃত ফল পাওয়া যাবে না।

চতুর্থ, মনোবিজ্ঞানে পরীক্ষণের বিষয়বস্তু বিভিন্ন প্রকারের। তাছাড়া পরীক্ষণ পাত্রদের মধ্যে ব্যক্তি পার্থক্য থাকায় পরীক্ষণ পদ্ধতি সকলের ওপর যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যায় না। যেমন এই পদ্ধতিতে আবেগের বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ বেশ অসুবিধাজনক। কারণ প্রয়োজনমতো কৃত্রিম উপায়ে যথার্থ আবেগ সৃষ্টি করা যায় না। অনুরোধ করা মাত্রই কোন ব্যক্তি হাসতে বা কাঁদতে পারে না। তদ্রূপ শিক্ষণ এবং বর্ধনের ক্ষেত্রেও পরীক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগের বিশেষ অসুবিধা আছে। আবার অনেক সময় সামাজিক পরিবেশ থেকে পৃথক করে কৃত্রিম পরিবেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালে মানুষের ব্যক্তিত্বের যথার্থ পরিচয় মেলে না। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url