মনোবিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি
মনোবিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি (Methods of Observation)
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলির মধ্যে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি সবচেয়ে সহজ এবং সরল। মনোবিজ্ঞানও এই পদ্ধতি ব্যবহার করে। এ পদ্ধতির দুটি ভাগ আছে। যথা-অনিয়ন্ত্রিত এবং নিয়ন্ত্রিত।
অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ (Uncontrolled Observation) : অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ আবার দুই প্রকার। যথা-প্রাকৃতিক বা আকস্মিক পর্যবেক্ষণ এবং প্রণালীবদ্ধ পর্যবেক্ষণ। প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবের আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হল প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণ। মানুষ বা প্রাণী স্বাভাবিক পরিবেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে আচরণ প্রকাশ করে তার পর্যবেক্ষণই হল প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি। প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে কোন ব্যক্তি বা প্রাণীকে গবেষণাগারে আনা হয় না। জীব যেখানে বাস করে কিংবা যেখানে চলাফেরা করে সেখানে তার গতিবিধির ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ না এনে বা তার চলাফেরায় কোন বাধা সৃষ্টি না করে তার আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেমন সদ্যজাত শিশুর অঙ্গভঙ্গি এবং সে যেসব শব্দ করে সেগুলি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার আচরণের বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করা যায়। স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে যদি কোন জীবকে গবেষণাগারের নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে আনা হয় তবে তার আচরণের স্বাভাবিক প্রকাশ ব্যাহত হয়। এজন্য পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত পণ্ডিত, অনেক সাহিত্যিক ও কবি, অনেক দার্শনিক স্বাভাবিক পরিবেশে প্রকাশিত মানুষের অনেক আচরণ পর্যবেক্ষণপূর্বক তার সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য প্রকাশ করে থাকেন।
সুসংবদ্ধ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতে ব্যক্তির আচরণ সম্পর্কে আনুমানিক সত্য বা দৈব বিশ্বাসের (Chance Impression) ওপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। বরং কোন একটি বিশেষ আচরণকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন পরিবেশে পুরোপুরিভাবে পর্যবেক্ষণ করে তবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রত্যেকটি পরিবেশেই আচরণের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায় এবং সাথে সাথে সেগুলির প্রকাশভঙ্গিও লিপিবদ্ধ করা হয়। এসব ক্ষেত্রে পরীক্ষক কোন চলকে পরিবর্তন করে তার ফলাফল লক্ষ করেন না। তিনি শুধু আচরণের বৈশিষ্ট্যগুলি লিখে রাখেন। যেমন কোন নেতৃত্বসুলভ আচরণ পর্যবেক্ষণে তিনি এর কয়েকটি নির্দিষ্ট মান বা দিক আগেই ঠিক করে নেবেন। যেমন সাংগঠনিক ক্ষমতা, নিজের বুদ্ধি ও মেধার বলে অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি। তারপর শিশু যেখানে অন্যান্য সমবয়সীদের সাথে খেলা করে, কিংবা বাগানে কাজ করে পর্যবেক্ষক সেখানে উপস্থিত হয়ে দূর থেকে শুধুমাত্র তার আচরণের এইসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করবেন এবং তাঁর খাতায় সেগুলি টুকে নেবেন। এখনও হতে পারে পর্যবেক্ষক ছেলেদের সাথে এমনভাবে বন্ধুত্ব স্থাপন করবেন যাতে তাঁর উপস্থিতি তাদের কাজে বা খেলায় কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। কিংবা পর্যবেক্ষক তাদের সামনে উপস্থিত না হয়ে পর্দার আড়ালে থেকেও আচরণ লক্ষ করতে পারেন যাতে তাদের আচরণের স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গি ব্যাহত না হয়।
প্রণালীবদ্ধ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে একজন গবেষক যখন কোন সামাজিক বিপ্লব বা সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে অনুসন্ধানকার্য চালান তখন তিনি সাধারণত বিভিন্ন জনসভায় যোগদান করেন, নেতৃবর্গ ও তাঁদের অনুসারীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন, তাদের বক্তৃতা শোনেন। এভাবে তাদের আচরণ সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কারে সক্ষম হন। যেমন জনগণ কোন রাজনৈতিক দল পছন্দ করে, কোন সংবাদপত্র তাদের কাছে প্রিয়, ধর্ম বা শিক্ষা সম্পর্কে তাঁদের মনোভাব কি, তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক মানওবা কিরূপ প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে তিনি অনেক তথ্য খুঁজে বের করতে পারেন।
সুবিধা : যেসব পরিস্থিতিতে স্বতঃস্ফূর্ত আচরণের প্রকাশ ঘটে সেগুলি কোন না কোনভাবে আদর্শায়িত করা যেতে পারে। ফলে অন্য কোন পর্যবেক্ষক পুনরায় অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অথবা পরিস্থিতির পুনর্গঠনের মাধ্যমে একই আচরণ আবার পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
কখনও কখনও এই পদ্ধতিতে আচরণের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দেয়া হয় এবং কখনও কখনও আচরণের রেখাচিত্র অংকনের জন্য জটিল যন্ত্রপাতিরও ব্যবহার করা হয়। এই রেখাচিত্র অন্য কোন মনোবিজ্ঞানীও ব্যবহার করতে পারেন। এই পদ্ধতি সকল প্রকার প্রাণী, শিশু, আবাল- বৃদ্ধ-বণিতা ইত্যাদি সকল শ্রেণীর মানুষ এমনকি মানসিক রোগীদের ওপরও সমভাবে প্রয়োগ করা হয়।
অসুবিধা : এই পদ্ধতির কিছু ত্রুটিও আছে। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গৃহীত সার্বিক সিদ্ধান্ত নানা কারণে ভ্রমসংকুল হতে বাধ্য। প্রথমত, এই পদ্ধতিতে যে পরীক্ষণ পাত্রকে পর্যবেক্ষণ করা হয় সে কোন দল বা গোষ্ঠীর কিংবা কোন নির্দিষ্ট জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। কিংবা তাকে হয়তো কোন প্রতিকূল অবস্থায় পর্যবেক্ষণ করা হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আচরণের বাহ্যিক প্রকাশ পর্যবেক্ষণ করে যে সার্বিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা নির্ভুল হয় না। দ্বিতীয়ত, যিনি পর্যবেক্ষণ করেন তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে, কিংবা তাঁর প্রতিবেদন অবচেতন মনের প্রভাবে প্রভাবিত হতে পারে। ফলে তাঁর সিদ্ধান্ত ব্যক্তিনিরপেক্ষ হয় না। অথবা তাঁর প্রতিবেদন ব্যক্তিগত অনুভূতির চাপে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হয় না। তৃতীয়ত, এই পদ্ধতি বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারে না। ব্যক্তি মনে সচেতন স্তরের বিভিন্ন কার্যাবলি যেমন চিন্তন, প্রত্যক্ষণ, শিক্ষণ, অনুভূতি, প্রেষণা প্রভৃতির স্বরূপ জানতে হলে অন্তদর্শন পদ্ধতির সাহায্য নিতে হয়। চতুর্থত, অন্যের আচরণের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতার বিশেষ প্রয়োজন। এই প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা কোন অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকের অধীনে অর্জন করতে হয়। সকল পর্যবেক্ষকের হয়তো এ ধরণের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা নাও থাকতে পারে। ফলে তাদের সার্বিক সিদ্ধান্তগুলি ত্রুটিপূর্ণ হয়। তবে মনোবিজ্ঞানীরা আচরণ বিশ্লেষণে যখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন তখন তাঁরা সাধারণত সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন যাতে সিদ্ধান্তগুলি যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত হয়।