মনোবিজ্ঞানের অন্তদর্শন পদ্ধতি
মনোবিজ্ঞানের অন্তদর্শন পদ্ধতি (Method of Introspection of Psychology)
মনোবিজ্ঞানের শুরু থেকেই অন্তদর্শন পদ্ধতির ব্যবহার চলে আসছে। এই পদ্ধতির সাহায্যে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি সম্পর্কে জানা যায়। কাউকে যদি অন্তদর্শন করতে বলা হয় তাহলে প্রথমে সে একটু চিন্তা করবে তারপর অন্যের কাছে তার অনুভূতি বা অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে বলবে। সুতরাং অন্তর্দর্শনে ব্যক্তি সাধারণত তার অতীত ও বর্তমান অভিজ্ঞতা, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেগ, অনুভূতি মনোভাব ইত্যাদি সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তির চিন্তন, অনুভূতি এবং কোন বিষয় সম্পর্কে তার মনোভাব, ধারণা প্রভৃতি সচেতন প্রক্রিয়ার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণকেই বুঝায়।
অন্তদর্শন চেতন প্রক্রিয়ার একটা বিশেষ ব্যবস্থা। এর বিভিন্ন স্তর আছে। সচেতন অবস্থায় যখন কোন ঘটনা সম্পর্কে আমাদের অবগতি জন্মে তখন সেটা হল অন্তদর্শনের সর্বনিম্ন স্তর। ঘটনা সম্পর্কে অবগতির পর তা নিয়ে চিন্তা করা হলে সেটা হয় অন্তদর্শনের দ্বিতীয় স্তর। আর ঘটনা সম্পর্কে চিন্তা করার পর যখন তার প্রতি প্রতিক্রিয়া করা হয় তখন সেটা হয় তৃতীয় বা সর্বোচ্চ স্তর। যেমন কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় 'আপনি কি অবসর সময় বন্ধুবান্ধবের সাথে কাটাতে পছন্দ করেন?' তখন সে নিজের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অনুধাবন করে একটা সুচিন্তিত উত্তর দেবার চেষ্টা করে। এজন্য নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হয়। আপন অভিজ্ঞতার এই সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণই অন্তদর্শন। সাক্ষাৎকার, জনমত যাচাই, রেটিং স্কেল ইত্যাদি অন্তর্দর্শনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আচরণ অনুধ্যানের শুরু থেকেই মনোবিজ্ঞান অন্তদর্শন পদ্ধতি প্রয়োগ করে আসছে। যদিও এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয় তথাপি এর প্রয়োগকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা মানুষের জটিল মানসিক প্রক্রিয়া বাহ্যিকভাবে দেখা না গেলেও অন্তদর্শন তার সকল আচার-আচরণে পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে। আচরণ অনুধ্যানে এই পদ্ধতি প্রয়োগের সময় মনোবিজ্ঞানীরা যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করেন যাতে প্রাপ্ত তথ্যের যথার্থতা প্রতিপন্ন করতে বিশেষ বেগ পেতে না হয়।
যেহেতু আচরণ পরিবর্তনশীল সেহেতু এর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে প্রায়ই আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে যদি ব্যক্তির নিকট থেকে একটি অন্তর্দৃষ্টিমূলক প্রতিবেদন (Introspectine report) গ্রহণ করা হয় তাহলে তার সাহায্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের ব্যাখ্যাদান সম্ভব হয়। এ কারণেই মনোবিজ্ঞানে অন্তর্দর্শনের ব্যবহার আজও চলে আসছে।
সুবিধা
১. ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য সম্পর্কে জানতে হলে একমাত্র অন্তদর্শন পদ্ধতির দ্বারাই তা জানা সম্ভব হয়। কারণ সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তন, অনুভূতি সবই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ব্যক্তির এসব গোপন বিষয় একমাত্র অন্তদর্শন পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতির দ্বারা জানা সম্ভব নয়।
২. ব্যক্তির যেসব অভ্যন্তরীণ ঘটনা বা অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সরল-সহজ কিংবা যে সব বিষয় সম্পর্কে কারও কোন দ্বিমত থাকে না কেবলমাত্র সেসব বিষয়ের ওপর তথ্য সংগ্রহে এই পদ্ধতি সবচেয়ে সুবিধাজনক।
৩. এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিজ্ঞানসম্মত না হলেও এর সাহায্যে মাঝে মাঝে এমন সব তথ্য বেরিয়ে আসে যেগুলি অন্য কোন বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতির সাহায্যে যাচাই করে নেয়া যায়।
অসুবিধা
অন্তদর্শন পদ্ধতির সাহায্যে ব্যক্তির গোপন বিষয় প্রকাশের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এ পদ্ধতি ত্রুটিমুক্ত নয়। আচরণবাদীরা এই পদ্ধতির কঠোর সমালোচনা করেছেন।
১. এই পদ্ধতি কোন প্রকারেই পুনঃপ্রয়োগ করা যায় না। কারণ এই পদ্ধতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না। আবার এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অন্য কোন পরীক্ষক অথবা সেই পরীক্ষকের দ্বারা পুনঃপ্রমাণের কোন সুযোগ থাকে না।
২. এই পদ্ধতির প্রয়োগ ক্ষেত্র সীমিত। একমাত্র যাদের বুদ্ধি আছে এবং যারা কথা বলতে পারে কেবল তাদের ওপরেই এটি প্রয়োগ করা যায়। ফলে প্রাণী, শিশু, বোবা অথবা উন্মানসিক ব্যক্তির আচরণের আলোচনা এ পদ্ধতির দ্বারা সম্ভব নয়।
৩. এই পদ্ধতি শুধুমাত্র ব্যক্তির সচেতন স্তরের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা ও ঘটনা মনের অবচেতন স্তরে চাপা পড়ে থাকে। তাছাড়া এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা আছে যার সবগুলি বর্তমান মুহূর্তে স্মরণ করা যায় না। অন্তদর্শন মনের অবচেতন স্তরের সকল বিস্তৃত অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না। ফলে বর্তমান মুহূর্তে স্মরণকৃত অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যক্তি আচরণের কার্যকারণ সম্পর্কে গৃহীত সিদ্ধান্ত নির্ভুল নাও হতে পারে।
৪. স্মরণের মুহূর্তে ব্যক্তি অমনোযোগী থাকলে, দায়িত্ব জ্ঞানসম্পন্ন না হলে, বিশেষ কোন কারণে কোন অভিজ্ঞতা গোপন করলে, কিংবা অভিজ্ঞতাগুলি জটিল অথবা তর্কসাপেক্ষ হলে প্রাপ্ত তথ্য ভ্রমসঙ্কুল হতে পারে। ব্যক্তির জীবনে অনেক গোপন তথ্য থাকে যেগুলির প্রকাশে ব্যক্তির মনে হীনম্মন্যতাবোধ জাগে বা তার সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে সেগুলি সে প্রকাশ করতে চায় না। কাজেই এসব বিষয় সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য নির্ভুল হতে পারে না।
আচরণবাদীদের কঠোর সমালোচনা সত্ত্বেও মনোবিজ্ঞানের গবেষণা ক্ষেত্রে অন্তদর্শন পদ্ধতি আজও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কারণ মানসিক সত্তাকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না এবং প্রত্যেকেই এ সম্পর্কে সচেতন। বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ডেকার্তে (Decartes) বলেন, 'আমি বেঁচে আছি তার প্রমাণ আমি এখনও চিন্তা করতে পারি। সুতরাং প্রত্যেক মানুষ তার চিন্তা ও অনুভূতিকে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে বাধ্য। কিন্তু কেউ যদি মনে করে যে অন্যের চিন্তা, অনুভূতি এবং মনোভাব তার নিজেরই মত তাহলে সে নিজস্ব অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে অন্যের সম্পর্কেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু এইরূপ সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত এবং বিপজ্জনক।
তবে বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী Cooley (1926) তাঁর sympathetic penetration পদ্ধতির মাধ্যমে অন্তদর্শন পদ্ধতির সুবিধাগুলি সমর্থন করেছেন। এই পদ্ধতির সাহায্যে পরীক্ষক ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব এবং সহমর্মিতার সাথে অন্যের অনুভূতিকে জানার চেষ্টা করেন এবং অন্যের সাথে নিজেকে এমনভাবে একাত্ম করে নেন যাতে উভয়ের অনুভূতি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। অন্তদর্শন পদ্ধতির এই উপকারিতা পরীক্ষকের শিক্ষা এবং তার অভিজ্ঞতার পরিপক্বতার ওপর নির্ভর করে। শুধু তাই নয় এ সম্পর্কে সিদ্ধান্তটি অন্যের মুখমণ্ডলের বাহ্যিক অভিব্যক্তির সূক্ষ্ম ব্যাখ্যাদানের ক্ষমতার ওপরও নির্ভর করে। যদিও বিজ্ঞানসম্মত নয় তথাপি এই পদ্ধতির সাহায্যে আচরণ সম্পর্কে এমন কতকগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূত্র প্রণয়ন করা যায় যা পরবর্তীকালে কোন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির সাহায্যে পুনঃপ্রমাণ করে দেখা যেতে পারে। অনুসন্ধানে যদি কোন অনুমান সত্য প্রমাণিত নাও হয় তবুও অন্তদর্শন পদ্ধতিতে তার কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।