মনোবিজ্ঞানের জীবন ইতিহাস বা ব্যক্তি ইতিহাস পদ্ধতি

মনোবিজ্ঞানের জীবন ইতিহাস বা ব্যক্তি ইতিহাস পদ্ধতি (Life history or Case history Method)

মনোবিজ্ঞানের প্রধান বিষয়বস্তু ব্যক্তির আচরণ। এজন্য ব্যক্তির জীবনী আলোচনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতির সাহায্যে ব্যক্তির অতীত জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলির মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জীবন ইতিহাস থেকে ব্যক্তি আচরণ পর্যালোচনা অনুরূপ আর একটি পদ্ধতির নাম ক্রমবিকাশ (developmental) পদ্ধতি। ক্রমবিকাশ পদ্ধতিতে ব্যক্তির জীবনের একটি বিশেষ সময়ে তার ক্রমবিকাশে যে পরিবর্তন আসে তার ওপরেই বেশি জোর দেয়া হয়। এজন্য এই পদ্ধতিকে জীবন ইতিহাস পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতির তিনটি প্রকারভেদ আছে-

  • শিশুর দৈনন্দিন ঘটনা বিবরণী পদ্ধতি (Day book or baby book method) 
  • ব্যক্তি ইতিহাস পদ্ধতি (Case history method)
  • জীবন বৃত্তান্ত পদ্ধতি (Biographical method)

দৈনন্দিন ঘটনা বিবরণী পদ্ধতি : শিশুর দৈনন্দিন পুস্তক পদ্ধতিতে শিশুর স্বাভাবিক ক্রমবিকাশে সে কখন প্রথম হাসে, কখন প্রথম শব্দ করে, কখন প্রথম কথা বলে, কখন প্রথম বসতে শেখে, কখন প্রথম দাঁড়াতে পারে, কখন প্রথম হাঁটতে শেখে, কখন প্রথম অসুস্থ হয় ইত্যাদি ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। সাধারণত মায়েরা একটি ছোট খাতায় বা নোট বইয়ে শিশুর দৈনন্দিন জীবনের টুকিটাকি ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করে রাখেন। এই রেকর্ড বইয়ের সাহায্যে শিশুর ক্রমবিকাশে কোন বিশেষ আচরণের কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

ব্যক্তি ইতিহাস পদ্ধতি : কোন ব্যক্তির বর্তমান আচরণ ভালোভাবে বুঝবার জন্য তার অতীত অভিজ্ঞতাসমূহের তথ্য সংগ্রহের নামই ব্যক্তি ইতিহাস পদ্ধতি। ব্যক্তির বর্তমান মানসিক অবস্থা সুষ্ঠুভাবে জানতে হলে তাকে তার অতীত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। এ কারণে ব্যক্তির অতীত ইতিহাস জানার দরকার হয়। আর ব্যক্তির অতীত ইতিহাস জানাই এই পদ্ধতির প্রধান লক্ষ্য।

সাধারণত দুটি উপায়ে ব্যক্তির অতীত জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রথমত, ব্যক্তিকে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তার অতীত জীবনের ঘটনাবলি জানা এবং দ্বিতীয়ত, তার পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলের মারফতে তার সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ করা। এছাড়াও তার অতীত জীবনের অসুখ-বিসুখ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রেকর্ড, পূর্ব নিয়োগকর্তার নিকট থেকে রিপোর্ট, চরিত্র সম্পর্কে রিপোর্ট ইত্যাদি। অবশ্য এ ধরনের তথ্য রোগী পরীক্ষা পদ্ধতিতেও সংগ্রহ করা হয়, তবে তা বিশেষ উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য রেখে করা হয়। যেমন বিশেষ ধরনের অস্বভাবী আচরণের কারণ ও স্বরূপ নির্ণয় এবং তা দূরীকরণের জন্য এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ইতিহাস পদ্ধতিকে রোগী পরীক্ষা পদ্ধতির সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অস্বভাবী আচরণ সম্পর্কে অনুসন্ধানকালে রোগীর পূর্বকালীন অবস্থা, তার বংশগতির ইতিহাস জানা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ কারণেই ব্যক্তি ইতিহাস পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

এই পদ্ধতি প্রয়োগের সময় মনোবিজ্ঞানীকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ ব্যক্তি তার অতীত জীবনের ঘটনাবলি আলোচনাকালে অনেক কল্পকাহিনীর সাহায্য নিতে পারে। তাছাড়া তার বর্তমান জীবনের অস্বভাবী আচরণের কারণ হিসেবে অতীত জীবনের কোন বিশেষ ঘটনাটি দায়ী তা উদ্ঘাটনের জন্য মনোবিজ্ঞানীকে ব্যক্তির অতীত ইতিহাস আলোচনাকালে বিশেষ বিশেষ পর্যায়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হয়।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে ব্যক্তি ইতিহাস পদ্ধতির অনেক ত্রুটি ধরা পড়ে। প্রথমত, এই পদ্ধতি অতীত দৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। অতীত ঘটনা ঘটবার পরে সে সম্পর্কে চিন্তা করে উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু দুর্বল ও অসম্পূর্ণ স্মৃতিশক্তির দরুন ব্যক্তি সব ঘটনা যথার্থভাবে উল্লেখ করতে পারে না। সুতরাং ঘটনাবলি স্মরণ করার সময় ব্যক্তি যা বলে তাই বিশ্বাস করে নিতে হয়। দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতি এমন জটিল যে এর পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। ফলে অন্য কোন মনোবিজ্ঞানী প্রাপ্ত ফলাফল পুনঃপরীক্ষা করে দেখতে পারেন না। তবে এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য যেসব অভিভাবনীয় উপাদানের সন্ধান দেয় সেগুলিই যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ হবে সে বিষয়েও কোন নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তৃতীয়ত, এই পদ্ধতির সাহায্যে গৃহীত তথ্যের ব্যাখ্যা বিভিন্ন রকম হতে পারে। কোন একটি বিশেষ ঘটনা হয়তো জীবনের বিভিন্ন জটিল সমস্যার মূল কারণ হতে পারে। সুতরাং কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হলে একই ধরনের অনেকগুলি ঘটনার ফলাফলকে বিবেচনায় আনতে হয়। চতুর্থত, এই পদ্ধতি আচরণগত দুটি ঘটনার কেবলমাত্র বর্ণনামূলক কার্যকারণ নির্ণয় করতে সক্ষম। নিরপেক্ষ ও নির্ভরশীল চলের মধ্যে কোন পরিমাণগত সম্পর্ক দেখাতে পারে না।

তবে এই পদ্ধতির কিছু কিছু সুবিধাও আছে। অন্তদর্শন এবং রোগী পরীক্ষা পদ্ধতির ন্যায় ব্যক্তি ইতিহাস পদ্ধতির সাহায্যে অনেক মূল্যবান তথ্য খুঁজে বের করা যায় যেগুলির ওপর প্রকল্প তৈরি করে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে অন্য কোন বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতির সাহায্যে পরীক্ষা করা যায়। তাছাড়া এই পদ্ধতি মনুষ্য আচরণের প্রকারভেদ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান অর্জনে বিশেষ সাহায্য করে।

জীবন কাহিনী পদ্ধতি : জীবন কাহিনী পদ্ধতি মানুষের আত্মজীবনী বা অন্যের দ্বারা রচিত জীবন কাহিনী থেকে বৈধ ঘটনা বা ধারণা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে। এখানে মনোবিজ্ঞানীর প্রধান কাজ হল অতীতের যেসব ঘটনাকে তিনি ব্যক্তির বর্তমান আচরণের জন্য দায়ী বলে মনে করেন সেগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা। আচরণের বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনায় এই পদ্ধতি বিশেষ সুবিধাজনক নয়। কারণ জীবনচরিত লেখক নিজে মনোবিজ্ঞানী নন। তিনি ব্যক্তির জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনাকে অন্য ব্যাখ্যাদানের জন্যও তুলে ধরতে পারেন। তিনি ব্যক্তির জীবনের অনেক গোপনীয় ঘটনা নাও জানতে পারেন। এছাড়াও যারা জীবনচরিত লেখেন তাঁদের লেখার মধ্যে নিজস্ব ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, উদ্দেশ্য ও অনুভূতির প্রভাব বিদ্যমান। জীবনচরিতগুলি লেখকের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা বা প্রেষণার প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। ফলে ব্যক্তির দোষ বা গুণাবলীর বর্ণনায় তাঁরা নিরপেক্ষ নাও হতে পারেন। সুতরাং খুব বেশি কিছু হলেও এই পদ্ধতিকে জীবন বিকাশের প্রাথমিক স্তরের আলোচনার একটি বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করা যায়। যখন অন্য কোন পদ্ধতির সাহায্যে ব্যক্তির আচরণ পর্যালোচনা করা সম্ভব নয় কেবল তখনই এই পদ্ধতির সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

সব ধরণের জীবন ইতিহাস পদ্ধতিতে ব্যক্তি জীবনের ঘটনাবলী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ধারা একই। সুতরাং এক জাতীয় সকল পদ্ধতির স্বরূপ একই ধরনের। এদের মধ্যে যে পার্থক্য তা নির্ভর করে কি উদ্দেশ্যে এক একটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তার ওপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি আর একটি পদ্ধতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। বিশেষ করে মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আচরণ অনুধ্যানের বিভিন্ন প্রকার জীবন ইতিহাস পদ্ধতির কার্যাবলী একে-অন্যের সম্পূরক ও সহায়ক।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url