মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষণ পদ্ধতি

মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষণ পদ্ধতি (Experimental Method)

বিজ্ঞানের সাহায্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমরা বস্তুনিষ্ঠ ও যথার্থ জ্ঞান পেয়ে থাকি। আর পরীক্ষণের মাধ্যমে এই জ্ঞান আহরণ করা হয়। পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের যথার্থতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া যায়। পরীক্ষণ পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলা হয়। মনোবিজ্ঞানের জীবের আচরণ বিশ্লেষণে এই পরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আর এই পরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহারের কারণেই মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

সুনিয়ন্ত্রিতভাবে সৃষ্ট কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যে আচরণের সুষ্ঠু পর্যবেক্ষণকেই পরীক্ষণ পদ্ধতি বলা হয়। পরীক্ষক কৃত্রিম উপায়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেন যেখানে পরীক্ষণ পাত্র নিজের স্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ করতে পারে। মনোবিজ্ঞানে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে পরীক্ষণ পদ্ধতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সকল পদ্ধতির মধ্যে এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত জ্ঞানের বৈধতা, বস্তুনিষ্ঠতা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং ফলাফলের বিশুদ্ধতার দাবি রাখে। বস্তুনিষ্ঠতা এবং নিয়ন্ত্রণের মাত্রা অধিক বলে এই পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মর্যাদায় উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। এই পদ্ধতির মূল কথা হল কোন পর্যবেক্ষণ পরিচালনার পূর্বে পরীক্ষণকারী সমস্যাটিকে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেন। তারপর সমস্যা সম্পর্কে একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রকল্প তৈরি করেন। তাছাড়া কিরূপ অবস্থার মধ্যে অনুসন্ধানকার্য চালানো হবে, কোন প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত উপাত্ত তথা ফলাফলের মূল্যায়ন করা হবে এই বিবৃতির মধ্যে তার খসড়া চিত্র বর্ণিত হয়। খসড়া চিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিবরূপ : 

(ক) পরীক্ষণকারী একটি মাত্র চলের পরিবর্তন ঘটান;

(খ) অন্যান্য সম্ভাব্য চল যেগুলি নিয়ন্ত্রণ না করলে পরীক্ষণের ফলাফল আশানুরূপ হবে না বলে আশংকা জন্মে সেগুলি যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা হয়;

(ঘ) আর যে চলটি পরিবর্তন করা হয় পরীক্ষণ পাত্রের ওপর এই পরিবর্তনের কি প্রভাব পড়ে তা অনুসন্ধান করা হয়। অন্য কথায় একটি চলকে পরিবর্তন করার ফলে পরীক্ষণ পাত্রের আচরণে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় পরীক্ষক তাই লক্ষ করেন।

প্রকল্প (Hypothesis) : পরীক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহার করতে হলে পরীক্ষণকারী আগেই একটি প্রকল্প তৈরি করেন। একটি বিশেষ চলের পরিবর্তনে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে পরীক্ষণের আগেই প্রকল্পে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। প্রতিক্রিয়া যদি প্রকল্প বা অনুমান অনুযায়ী পাওয়া যায় তাহলে বলা হয় যে প্রকল্পটি সমর্থিত হল।

চল (Variable) : পরীক্ষণ পদ্ধতিতে যে প্রকল্পের উল্লেখ থাকে তার মধ্যে কমপক্ষে দুটি চল থাকে। এর একটিকে বলা হয় অনির্ভরশীল (Independent) চল যেটি পরীক্ষণকারী নিজেই পরীক্ষণ পাত্রের ওপর প্রয়োগ করেন। এই চল প্রয়োগের ফলে পরীক্ষণ পাত্রের আচরণের ওপর কি প্রভাব পড়ে পরীক্ষণকারী সাধারণত তা-ই লক্ষ করেন। অন্য চলটি নির্ভরশীল চল (dependent variable)। অনির্ভরশীল চলের পরিবর্তনের ফলে পরীক্ষণ পাত্রের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তাই নির্ভরশীল চল। কেননা এই চল সম্পূর্ণরূপে অনির্ভরশীল চলের ওপর নির্ভরশীল।

উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক একটা প্রকল্প তৈরি করা হল 'কোন বিষয় শিক্ষণের পরে নিদ্রা গেলে ঐ বিষয়ের স্মৃতি সংরক্ষণের পরিমাণ বেশি হয়।' এখানে নিদ্রা অনির্ভরশীল চল এবং স্মৃতি সংরক্ষণের পরিমাণ হবে নির্ভরশীল চল। এক্ষেত্রে পরীক্ষক দু'দল পরীক্ষণ পাত্র নেবেন। এদের বয়স, বুদ্ধি, শিক্ষা, স্মৃতি সংরক্ষণ ক্ষমতা, লিঙ্গ এবং সামাজিক মর্যাদা যতদূর সম্ভব একইরূপ হবে। উভয় দল কোন একটি নির্দিষ্ট পাঠ শিখবে। বিষয়টি আয়ত্ত করবার পর একদল অন্য কোন কাজ না করে একটা নির্দিষ্ট সময় নিদ্রা যাবে। কিন্তু দ্বিতীয় দল বিষয়টি আয়ত্ত করার পর প্রথম দল যত সময় অবধি নিদ্রা যাবে ঠিক তত সময় পর্যন্ত অন্য কোন কাজে ব্যাপৃত থাকবে। তারপর উভয় দল পুনরায় একই সময়ে তাদের শিক্ষালব্ধ পাঠটি মুখস্থ বলবে। এতে যদি দেখা যায় যে প্রথম দল দ্বিতীয় দলের চেয়ে অধিক পরিমাণ বিষয়বস্তু স্মরণ করতে পেরেছে তবেই বলা যাবে যে প্রকল্পটি সমর্থিত হল।

এই স্বতন্ত্র ও নির্ভরশীল চল ছাড়াও পরীক্ষণ পদ্ধতিতে আর এক ধরনের চলকে বিবেচনায় আনা হয়। এই চলকে বলা হয় অন্তর্বর্তী (intervening) চল। এর অপর নাম অনুমানসিদ্ধ ধারণা (hypothetical construct)। সাধারণত অন্তর্বর্তী চল বলতে পরীক্ষণ পাত্রের সচেতন প্রক্রিয়াকেই বুঝায়। এই চলকে বাহ্যিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তবে অভ্যন্তরীণভাবে এটি পরীক্ষণ পাত্রের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে এবং অনির্ভরশীল ও নির্ভরশীল চলের মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপন করে। এজন্য একে অন্তর্বর্তী বা মধ্যস্থতাকারী চল বলা হয়। পরীক্ষণ পাত্রের প্রেষণা, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, মনোভাব, বুদ্ধি, অনুভূতি, শিক্ষা পূর্ব অভিজ্ঞতা, বয়স প্রভৃতি এই চলের অন্তর্ভুক্ত। পরীক্ষণ পাত্র উদ্দীপকের দ্বারা উদ্দীপিত হবার পর থেকে প্রতিক্রিয়া করা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অন্তরবর্তী চল কাজ করতে থাকে। এগুলিকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরীক্ষণের ফলাফল আশানুরূপ নাও হতে পারে। অনির্ভরশীল, নির্ভরশীল এবং অন্তর্বর্তী চল ছাড়াও পরিবেশ তথা সেখানকার আলো, বাতাস, গোলমালের অপসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে এগুলি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। শব্দ এগুলি পরীক্ষণে প্রভাব বিস্তার করে। এগুলিকে বাহ্যিক চল বলে।

নিয়ন্ত্রণ (Control) : পরীক্ষণ পদ্ধতির একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নিয়ন্ত্রণ। পরীক্ষণের সময় অনির্ভরশীল চলের সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য আনুষঙ্গিক চলগুলি নিয়ন্ত্রণ করার দরকার হয়। পরীক্ষক শুধুমাত্র অনির্ভরশীল চলটিকে পরিবর্তন করেন এবং অন্যান্য চলগুলি স্থির রেখে পরীক্ষণ পরিচালনা করেন। এই চলগুলি অপরিবর্তিত না রাখলে পরীক্ষণের ফলাফল সঠিক নাও হতে পারে। যে চলের প্রভাব খুঁজে দেখা হবে শুধুমাত্র সেই চলের মধ্যে পরিবর্তন এনে অন্যান্য যেসব চলের প্রভাবে ফলাফল প্রভাবিত হতে পারে সেগুলি অপরিবর্তিত বা একই অবস্থায় রাখার নাম নিয়ন্ত্রণ। যেমন উপরোক্ত উদাহরণে যে দু'দল পরীক্ষণ পাত্রের উল্লেখ করা হয়েছে তাদের বয়স, বুদ্ধি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্মরণশক্তির মাত্রা ইত্যাদি যথাসম্ভব একইরূপ হতে হবে। এছাড়া উভয় দলের শিক্ষার্থীরা হয় ছেলে নতুবা মেয়ে হবে। পরীক্ষণের প্রতি উভয় দলকেই সমান আগ্রহশীল করতে হবে এবং পরীক্ষণের প্রতি তাদের মনোভাব অনুভূতি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে পরীক্ষণের প্রতি যেন তাদের কোন বিতৃষ্ণা সৃষ্টি না হয়। এভাবে আনুষঙ্গিক চলগুলি নিয়ন্ত্রণ করা হলে ধরে নেয়া যেতে পারে যে পরীক্ষণের ফলাফল সঠিক হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url